১০ জুন ২০২৩ শনিবার সন্ধ্যায় টরন্টোর একটি মিলনায়তনে ভিন্নধারার সংগঠন ‘আলো দিয়ে যাই’ এর উদ্যোগে টরন্টোর আলোকিত কবি কাজী হেলালের কবিতার উপর কথামালা, তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশিত কাব্যের মোড়ক উন্মোচন, ও কবির কবিতার আবৃত্তির সন্নিবেশনায় এক অনন্য আয়োজন ‘কবিতায় ডুবসাঁতার’ অনুষ্ঠিত হয়। কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী, সাহিত্য অনুরাগী- সব শ্রেণীর দর্শকের সমাগমে হলভর্তি এক মনোরম পরিবেশে সঙ্গীতশিল্পী ফারহানা শান্তা’র একটা আলোর গানের ভিতর দিয়ে এই আয়োজনের শুরু।
ফারহানা আহমেদ ও ফ্লোরা নাসরিন ইভা’র শিল্পিত, পরিমি্ সাবলীল সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্যে ‘আলো দিয়ে যাই’-এর প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক জামিল বিন খলিল উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানিয়ে বলেন ‘আলো দিয়ে যাই’ কোন সংগঠন নয়, এটি একটি চেতনা, একটি অঙ্গীকার, একটি আলোর মিছিল। ‘মানুষের মননে ও সমষ্টিগত চলার পথের পরতে পরতে কিছুটা আলো ছড়িয়ে দিতেই আলো দিয়ে যাই- এর আত্মপ্রকাশ ও পথচলা’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কবির কলম বেঁয়ে নির্গত শুভ্র স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে দিতেই এধরণের আয়োজনের উদ্যোগ নিয়ে যাবে আলো দিয়ে যাই’।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রয়াত কবি ইকবাল হাসান-এর স্মরণে ও শ্রদ্ধায় দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালনের পর সংক্ষিপ্ত কবি পরিচিতি তুলে ধরেন লিনা এগেন্স ডি কস্তা। তারপর কবি কাজী হেলাল ও তাঁর কাব্যচর্চার উপর সারগর্ভ বক্তব্যে একে একে কবি দেলওয়ার এলাহী, লেখক ও নাট্যকার আকতার হোসেন এবং কবি, লেখক, গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী হাসান মাহমুদ সকলেই কবি কাজী হেলালকে সময়ের একজন আলোকিত কবি হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর বলিষ্ঠ ও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য নিয়ে কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। কাজী হেলালের কবিতা মানুষের কথা বলে, সময়ের কথা বলে, দ্রোহের কথা বলে, ভালবাসার কথা বলে, একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে উল্লেখ করে সকলেই বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও মানুষে মানুষে বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজী হেলালের ক্ষুরধার লেখনী অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
কবি মেহরাব রহমান, কবি হাসান মাহমুদ, দেলওয়ার এলাহী, আকতার হোসেন, কবিপত্নী নিপা কাজী সম্মিলিতভাবে কবি’র ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত পাঠকনন্দিত ‘শ্রাবণীর চোখে স্থলপদ্ম’ কাব্যের মোড়ক উন্মোচন করেন। ‘আলো দিয়ে যাই এর পক্ষ থেকে কবিকে ফুলেল অভিনন্দন জানান আলোককর্মী সোমা সাইদ এবং কবির হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন আলো দিয়ে যাই-এর আলোক অভিভাবক মির্জা রহমান। আবৃত্তি সংগঠন বাচনিক ও শিশুকিশোর সংগঠন খেলাঘর কানাডা’র পক্ষ থেকে কবিকে ফুলেল অভিনন্দন জানানো হয়।
অভিব্যক্তি জানাতে গিয়ে কবি কাজী হেলাল উপস্থিত সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানান এবং এধরণের আয়োজনের জন্য আলো দিয়ে যাই-এর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সবার ভালবাসা আর ধারাবাহিক প্রেরণাতেই কবিতায় তাঁর পথচলা, আর এই ভালবাসাকে সাথে নিয়েই তিনি তাঁর কবিতায় মানুষ, জীবন আর মানবতার জয়গান গেয়ে যাবেন।
এই আয়োজনে কবিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন কবি ও লেখক তাসরিনা শিখা।
আর্থিক সহযোগিতার উদার হাত বাড়িয়ে এই আয়োজনকে সফল করতে এগিয়ে আসা তিন পৃষ্ঠপোষক ব্যারিস্টার শামীম আরা, আসহাবউদ্দিন খান আসাদ ও হিশাম চিশতি- তাঁদের প্রতি আলো দিয়ে যাই-এর পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। পৃষ্ঠপোষকদের হাতে কৃতজ্ঞতা স্মারক হিসেবে ক্রেস্ট তুলে দিয়ে আলো দিয়ে যাই-এর আলোক শুভার্থী বাংলা মেইল পত্রিকার সম্পাদক ও এনআরবি টেলিভিশনের সিইও শহিদুল ইসলাম মিন্টু এধরণের আলোকিত কাজে সকল পৃষ্ঠপোষকদের আরও বেশী এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে এধরণের একটি অনন্য আয়োজনের জন্য আলো দিয়ে যাই-কে অভিনন্দন জানান।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে কবির দুটো কাব্য থেকে টরন্টোর স্বনামধন্য আবৃত্তিশিল্পীরা মোট চৌদ্দটি কবিতার আবৃত্তি পরিবেশনায় পুরো মিলনায়তন জুড়ে স্নিগ্ধ এক কবিতাময় আবহের সৃষ্টি করেন। বিভিন্ন আঙ্গিকের ভিন্ন ভিন্ন আবহের এই কবিতামালায় একদিকে যেমন ইতিহাস উঠে আসে, একাত্তর আর বঙ্গবন্ধু উঠে আসে, জর্জ ফ্লয়েডের আর্তনাদের হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে, উঠে আসেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, উঠে আসে মঙ্গল পান্ডে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানবতার জয়গানে ভালবাসার কলতানে আর অঙ্গীকারের দেদীপ্যমানতায় একের পর এক কবিতায় মুগ্ধ হোন উপস্থিত দর্শক শ্রোতারা। আবৃত্তিশিল্পীদের মধ্যে ছিলেন- সুমন মালিক, ববি রাব্বানী, দিলারা নাহার বাবু, মেরী রাশেদীন, শাপলা শালুক, হোসনে আরা জেমী, কামরান করিম, অরুণা হায়দার, মার্জিয়া মৌ, তন্ময় রহমান, কামরুননাহার হিরা ও নাজমা কাজী।
বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী মাহিদুল ইসলাম মাহির কন্ঠে ‘দুই শব্দের মহাকাব্য’ কবিতার আবৃত্তির সাথে অরুণা হায়দারের বিশেষ নৃত্য এবং অরুণা হায়দারের কন্ঠে ‘জননী উপাখ্যান’ কবিতার সাথে ফারজানা সোনিয়ার নৃত্য ছিল অনবদ্য। কবিতার সাথে সঙ্গীতশিল্পী সোমা সাইদের ‘প্রাণও ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ’- এই আলোর গানের অসাধারণ পরিবেশনাও ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। টরটোর পরিচিতমুখ রিংকুর অসাধারণ শব্দ নিয়ন্ত্রণ অনুষ্ঠানকে আরও শ্রুতিময় করে তুলেছে।
এই আয়োজনের উপর একটা স্বল্প কলেবর নান্দনিক স্যুভেনীর উপস্থিত সকলের ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। সব মিলিয়ে একটা অনন্য উজ্জ্বল আয়োজন ছিলো ‘কবিতায় ডুবসাঁতার’। শুভ্র, সুন্দর, ঝলমলে রোদেলা কবিতাময় স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় সমৃদ্ধ কথামালা, হীরকোজ্জ্বল সব কবিতার অসাধারণ আবৃত্তি, গান, নৃত্য- আক্ষরিক অর্থেই ‘কবিতায় ডুবসাঁতার’ শিরোনামের আয়োজনে উপস্থিত দর্শকরা ডুবেছিল কবিতার সরোবরে।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে জামিল বিন খলিল জানান- ‘আলো দিয়ে যাই গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে এধরণের আলোকিত কাজ করে যেতে চায়। সবার অব্যাহত সমর্থন আর সহযোগিতাতেই কেবল সেটা সম্ভব। আমরা আলোক-প্রত্যাশী সবার সহযোগিতা চাই, সবাইকে পাশে চাই’।