
শিল্পের নানা মাত্রার বিশুদ্ধ রং ও সুর নিয়ে ধ্রুপদী আালাপনের ব্যঞ্জনা পাথেয় করে গত ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ধ্রুবপদ পারফর্মিং আর্টস আর্টস রিসার্চ সেন্টার আয়োজিত সুরের আলাপন এর “সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা”। শুরুতেই শুভেচ্ছা পর্বে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কানাডা সংসদ এর সভাপতি সুভাষ দাস বক্তব্য রাখলেন তার ধীর ও শান্ত কন্ঠে। কানাডার বাংলামেইল পত্রিকা ও এনআরবি টিভির কর্ণধার শহিদুল ইসলাম মিন্টু বলেন, তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন কমিউনিটির প্রতি দাায়িত্ব বোধ ও ভালবাসার বিনিময়ে। মন্ট্রিয়ল থেকে ছুটে এসেছেন ‘এ ওয়ান টিউটোরিয়াাল’ এর কর্ণধার, এনআরবি টিভির ডিরেক্টর ও সাপ্তাহিক বাংলামেইল এর নির্বাহী সম্পাদক কাজী আলম বাবু। মঞ্চে উঠে তার বক্তব্যে এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ড.মমতাজ মমতার সুশিক্ষা, দক্ষতা ও দায়িত্বের প্রশংসা করেন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের নির্দেশক ড. ইখতিয়ার ওমর তাঁর বক্তব্যে নতুন প্রজন্মের মধ্যে শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।
দুই পর্বের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রথমেই নকুল দে ও তার শিষ্য পরম্পরার সমবেত তবলা লহড়া সহজে সকলের মন কেড়ে নেয় । এরপর প্রতিষ্ঠানের শিশুদের পর্যায়ক্রমে সমবেত ও একক সংগীত পরিবেশন দর্শক শ্রোতাদের মুগ্ধ করে তোলে। শিশুদের পরিবেশনার সাথে সাথে শুভ্র পেশাকের উপর প্রতিষ্ঠানের উত্তরীয় গায়ে জড়িয়ে যখন সকলে মঞ্চে উপবিষ্ট ছিল তখন মনে হচ্ছিল অনেকগুলো স্নিগ্ধ সাদা ফুল থরে থরে সাজানো।
শিশু শিল্পীরা ছিলেন নিলয়, সৌহার্দ্য, হৃদ, আদিত, সরূপ, আদিপ, দিব্যজিত, অয়ন,আবির, সৌরভ, দেবস্মিতা, মিথিলা,আরোহন,
শায়েরি,সুকন্যা,অ্যান্ড্রিয়া ও এথিনা। শিশু শিল্পীদের বয়সের তুলনায় গভীর আঙ্গিকের গানের সাবলীল পরিবেশনা প্রশংসার দাবি রাখে। এক এক করে তারা গান পরিবেশন করেন। সাথে নাচ ও আবৃত্তি ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে।
নাদিরা ওমর এর মঞ্চ সজ্জায় রুচীর প্রকাশ স্পষ্ট। প্রতিষ্ঠানের ব্যানারের বাদামী রং এর সাথে মিল রেখে সাদা’র ছোয়ার মিষ্টি গাম্ভীর্য মঞ্চ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। । উপস্থাপনায় শ্রীজিৎ চৌধুরী ও নাজমা কাজীর বিনয় ও আন্তরিকতা লক্ষ্যনীয়।
দ্বিতীয় পর্বে গীতি আলেখ্য শিরোনাম নিয়ে সংগীতে ছিলেন শ্রদ্ধেয় নাদিরা ওমর ও ড.ইখতিয়ার ওমর এবং আবৃত্তিতে শিল্পী শেখর গোমেজ। শেখর গোমেজ তার পরিবেশনা দিয়ে শুরু করেন পর্বটি। তার কন্ঠের ঔদার্য ও টেক্সট আয়ত্ত করে পরিবেশার নিজস্ব ভঙ্গি সহজেই অনুধাবনীয়। এর পর ড.ইখতিয়ার ওমর ও নাদিরা ওমর তাদের ঝুড়ি থেকে দর্শকদের গান উপহার দেন একে একে- যেন নানা সুরের মালা গেঁথে চলেছেন। বোধের গভীরতা কন্ঠমাধুর্যের সাথে মিশে দর্শককে নিয়ে গেছে ভিন্ন জগতে। শ্রদ্ধেয় এই জুটিকে দেখে ভাবছিলাম, জীবনের একটি প্রান্তে এসে দুজনে একসাথে ধারাবাহিকভাবে সুন্দরের চর্চা ধরে রাখা ও একই মঞ্চে পরিবেশনা- এরকম একটি সুন্দর দৃশ্য, এটা বাংলাদেশেও বিরল। কাজী আব্দুল ওদুদ ও পরম্পরা, শিখা গোষ্ঠীসহ বাঙালী মুসলমানের মুক্ত বুদ্ধির আন্দোলনের ধারা পাঠ ও আহমেদ ছফার বাঙালী মুসলমানের মন পাঠ করলে- কেন বিরল তার কিছুটা ইঙ্গিত পওয়া যাবে। পশ্চিম বঙ্গে আমরা শিল্প সাহিত্যের জগতে অনেক জুটি পাই, যারা হাত ধরাধরি করে সারাজীবন শিল্প সাধনা করে গেছেন। ড.ইখতিয়ার ওমর ও নাদিরা ওমর শিল্পের হাত ধরে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
একটি অনুষ্ঠানের ও শিল্পের পেশাদার গঠনমূলক সমালোচনার দিকটি এড়িয়ে গিয়ে, নিজেকে ফিরে দেখার দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে কয়েকটি বিষয় হয়ত ভাবনার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। শিশুদের একটি সারি মঞ্চের মেঝেতে আর আরেক সারি টুলে বসলে হয়ত জায়গা সংকুলান হতো- কারণ দর্শক সারি মঞ্চ থেকে অনেক নিচে থাকায় দেখায় ব্যাঘাত হতো না। উপস্থাপকবৃন্দ মঞ্চের একদিকে আসন নিলে বা ডায়াস নিয়ে অবস্থান নিলে বার বার আাসা যাওয়ায় বিষয়টি এড়ানো যেত। অথবা যেহেতু জায়গা কম তারা প্রথমবার মঞ্চে এসে অনুষ্ঠান শুরু করে, বাকি উপস্থাপনা পেছন থেকে হয়ত করা যেত। কারন মঞ্চের চঞ্চলতা দর্শকদের মনের গতিকে প্রভাবিত করে। অনুষ্ঠান শুরু থেকে প্রথম পর্বের শেষ পর্যন্ত মোট সময়কে আরেকটু ছোট করা যেত, হয়ত। ষ্পট লাইটের আছে কিনা জানা নেই কন্তু আাশা করতে দোষ নেই। মঞ্চে ফ্ল্যাট লাইট আর স্পট লাইটের ব্যঞ্জনার পার্থক্য মঞ্চের লোক মাত্রই জানেন।
যাই হোক্, প্রবাস জীবনের অসংখ্য সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা পার করে একটি রুচিসম্মত অনুষ্ঠান উপহার দেয়ার জন্য এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে আলো ছড়িয়ে দেবার মত গুরু দায়িত্ব নেবার জন্য ড.মমতাজ মমতাসহ নেপথ্যের সকলকে সাধুবাদ জানাই। ধ্রবপদ পারফর্মিং আর্টস এবং রিসার্চ সেন্টারের উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি।