পহেলা বৈশাখ মানে বাঙালিয়ানায় ভরপুর একটি দিন। আমরা যে বাঙালি – এই পরিচয়টি সেদিন আমরা সবাই আবারও নতুন করে উন্মোচিত করতে চাই সারা বিশ্বের কাছে, উড়াতে চাই আমাদের স্বাধীন সবুজ পতাকাকে। এই পতাকা নিয়েই আমরা আজ পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি। তাই এই বাঙালিয়ানাকে ধরে রাখা তথা লালন করতে পারাটাও আজ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অধুনা বৈশ্বিক পেক্ষাপটে। ডিজিটাল যুগে যেখানে আজ সারা বিশ্ব একটি একক গ্লোবাল ভিলেজ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে, সেখানে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি আজ বেশ হুমকির মুখে পতিত। এ ছাড়াও রয়েছে আমাদের নিজেদের মধ্যে নানা দ্বিধা, সংকোচ, মতানৈক্য ও কুসংস্কার।এত সব বাধা অতিক্রম করে বাংলা সংস্কৃতি আর বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য রক্ষা করাটা দিন দিন দূরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও আশার বিষয় এই যে, সচেতন বাঙালিরা থেমে নেই। অন্তত বছরের এই একটি দিনে আমাদের বাঙালিয়ানার এই পরিচয়টাকে সবার সামনে আবারও উর্ধ্বে তুলে ধরতে নানা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। আর বাঙালিদের এই প্রয়াস শুধু বাংলাদেশ তথা পশ্চিম বাঙলায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা আজ আরো বহুগুণে প্রসার লাভ করে সারা বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।
২.
ঢাকা ও কোলকাতার পর বিশ্বের বড় বড় মহানগরী যেমন ল্ন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনী, টরন্টোসহ আরও বেশ কিছু প্রধান নগরীগুলোতে প্রবাসী বাঙালিরা পহেলা বৈশাখকে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করে আসছেন বেশ কিছু বছর যাবৎ। যেমন নিউইয়র্কের প্রধানতম ও প্রখ্যাত ব্যস্ত এলাকা টাইম স্কোয়ারে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে সাড়া জাগানো অনুষ্ঠানের আয়োজন ইতিমধ্যেই সারা বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। এটি কিন্তু বাঙালিদের জন্য কম অর্জন নয়! পহেলা বৈশাখকে আমেরিকার একটি আইকনিক এরিয়া টাইম স্কয়ায়ে নিয়ে সেখানে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আমি সাধুবাদ জানাই সেই সকল বাঙালিদের যারা এই মহান উদ্যোগটি সফল করতে সক্ষম হয়েছেন। আজ নিউইয়র্কের পর উত্তর আমেরিকার আরেকটি বাঙালি অধ্যুষিত সিটি টরন্টোও কিন্তু থেমে নেই এই মহান অভিযাত্রায়, আর সেই কাহিনী বলার জন্য এখানে এত কিছুর অবতারণা করলাম।
৩.
১৪৩১ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখের দিনটি টরন্টোর বাঙালি কমুইনিটির কাছে এবার বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ধরা দিয়েছে। এবারই প্রথম টরন্টোর বাঙালি কমুইনিটির সর্বস্তরের জনগণ মত ও পার্থক্য ভুলে সামিল হয়েছিল এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায়। যদিও বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন ব্যানারে স্ব স্ব উদ্যোগে অংশ নিয়েছিলো এবারের পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রায়, তবু সবাই ছিলো একই ঐক্যের সূত্রে গাঁথা – যা ছিলো বাঙালিয়ানা, বাঙালির পরিচয়কে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। আর এটি বেশ সহজ হয়ে যায় টরন্টোর মতো একটি
বহুসংস্কৃতির শহরে সহস্রাধিক বাঙালি যখন রাজপথ দিয়ে এক জমকালো শোভাযাত্রা বের করে। সত্যি এটি ছিলো এক অসাধারণ আয়োজন, যা অতীতের সব রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছে। মুহূর্তেই টরন্টো সিটির বাংলা টাউন একটি মিনি বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আমরা কেউ কেউ তখন ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমরা বাংলাদেশের বাইরে আছি! সবার মধ্যে এক অন্যরকম স্বতঃস্ফূর্তভাব লক্ষ করা গেছে। রঙিন ফেস্টুন, ব্যানার ও নানা মুখোশে সজ্জিত, এবং পাজামা পান্জাবি পরিহিত পুরুষেরা আর রঙিন শাড়ী পরিহিত নারীদের দৃপ্ত পদচারণায় মুখরিত হয়েছে এই বর্ণাঢ্য মিছিল! নজর কেড়ে নেয়ার মতো বিষয় ছিলো বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ ও স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরায় শোভাযাত্রাটির ফটোস্যুট করার দৃশ্যাবলী। ক্যামেরাধারী অনেক চ্যানেলের সদস্যগণ র্যালিতে অংশগ্রহণকারী অনেকের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন তাঁদের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে। আমার বেশ ভালো লেগেছে এমন একটি অনবদ্য প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পেরে।
৪.
শোভাযাত্রার আয়োজন ছাড়াও ড্যানফোর্ট বাংলা টাউনের কাছেই ডেনটোনিয়া পার্কের শহীদ মিনারের পাদদেশে আয়োজন করা হয়েছিল বৈশাখি মেলার। মেলার এক প্রান্তে বেশ বড় স্টেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি। টরন্টো সিটির স্থানীয় শিল্পীবৃন্দ এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ সমবেত সূচনা সংগীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। তারপর একের পর এক সংগীত পরিবেশন চলতে থাকে সারা সময়ব্যাপী। বিপুল দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালি ডেনটোনিয়া পার্কের পরিবেশকে এক নতুন মাত্রা দান করে। অন্যদিকে সারা মেলা প্রাঙ্গণ জুড়েও এক অন্যরকম আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মুখরিত হয় মানুষের স্বতঃফূর্ত পদচারনায়, বাঙালির জয় জয়কার ঘোষিত হয় সুদুর প্রবাসের মাটিতে, রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস। আমাদের সন্তানেরা প্রবাসের মাটিতে অনুভব করতে পারে তাদের নাড়ীর টান, সুযোগ লাভ করতে পারে তাঁদের আত্মপরিচয়ের শেকড় সন্ধানের। আমরা যে বাঙালি, বাঙালিয়ানা আমাদের পরিচয়, আমাদের অহংকার – সেই চেতনাটা অন্তত আমরা পেয়ে যাই এমন একটি আয়োজনের মধ্য দিয়ে – যেখানে আমাদের নতুন প্রজন্মের প্রবাসী বাঙালি ছেলেমেয়েরা তাঁদের শেকড়ের সন্ধানটুকু পেয়ে যাবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে এটি সত্যি একটি মহৎ আয়োজন এবং এর গুরুত্ব আমাদের এই প্রবাসের মাটিতে অপরিসীম। তাই এটি কিন্তু টরন্টো প্রবাসী বাঙালিদের কম অর্জন নয়! অংশগ্রহণকারী সবাই ছুটে গিয়েছিলেন প্রাণের টানে, ভালোবাসার বিমূর্ত আহ্বানে।
৫.
যতদূর জানতে পেরেছি – এবারের এই বৃহত্তর সার্বজনিন আয়োজনটির পেছনে ছিলো না তেমন কোন সমন্বয় পরিষদ। বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন ব্যানারে স্ব স্ব উদ্যোগে অংশ নিয়েছে এই আয়োজনে। যেমন আমি নিজেও একটি সংগঠনের ব্যানারে অংশ নিয়েছিলাম – নিজের উদ্যোগে ভালোবাসার টানে, তেমনি বাকীরা সবাই হয়ত। অবশ্য সংগঠনগুলোর নিজস্ব সদস্যদের মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ তথা পরিকল্পনা নিশ্চয়ই ছিলো। তবে যতদূর জেনেছি, কেন্দ্রীয়ভাবে তেমন কোন সমন্বয় ছিলো না, ছিলো না তেমন কোন স্পনসর। আর এগুলো থাকলে বোধহয় আরো একটু ভালো হতো। আশাকরি ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে সবাই সচেতন ভূমিকা পালন করবেন। এগিয়ে আসবেন বাঙালি কমিউনিটির অগ্রসরমান আগ্রহী নেতৃবৃন্দ; যাঁদের মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যতে এই অসাধারণ আয়োজনকে আরো সুসংহত ও জমকালোরূপে প্রত্যক্ষ করতে পারবো বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।