শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
12.9 C
Toronto

Latest Posts

জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ

- Advertisement -

।। পর্ব-৬২।।

- Advertisement -

নতুন কমিশনার হয়ে এলেন জনাব মাসুদ সাদিক। নব্বই দশকের শুরুতে আমি যখন কাস্টম হাউসের গ্রুপ-১ এর অ্যাপ্রেইজার,তখন নতুন সহকারী কমিশনার হিসেবে ঢাকা কাস্টম হাউসে এলেন তিনি এবং আমার গ্রুপের দায়িত্ব পেলেন। তিনি দেখতে সুন্দর, তাঁর ব্যবহারও ছিল চমৎকার। ছয় মাস তাঁর সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে, কখনো অন্যায়ভাবে কাউকে সুযোগ নিতে দেননি, সরকারি রাজস্বকে তিনি কিছু টাকার বিনিময়ে বিক্রয় করেন নি। আমাদের চিন্তার মৌলিক ধারণাটা বোধহয় একই ছিল, সেকারণেই তখন থেকেই আমরা পরষ্পরকে বুঝতে পারতাম। সে-সময় ওয়ার্ল্ড কাস্টমস ডে অথবা অন্য কোনো উপলক্ষে একটা ছোট্ট সুভেনির প্রকাশনার সিদ্ধান্ত হয়। সম্পাদক হলেন তিনি আর সহযোগী সম্পাদক হিসেবে সব কাজের দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। আমাকে তাঁর পক্ষে সম্পাদকীয় লিখে দিতে বললেন তিনি। তখনো দীর্ঘ সামরিক শাসন ও তাদের চেতনা বহনকারী গণতান্ত্রিক সরকারের প্রভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সর্বত্র প্রায় অচর্চিত ছিলেন। ছোট্ট সম্পাদকীয়তে আমি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ের কথা লিখে নিয়ে গেলাম। জানি না অন্য কোনো কর্মকর্তা হলে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতেন কীনা কিন্তু তিনি মৃদু হেসে বললেন, ভালো হয়েছে। এর কিছুদিন পর কোনো একটা কাজে আমি কলাবাগানে তাদের বাসায় যাই। সেটা তাঁর বাবার বাসা, তখনো তিনি সে বাড়িতে থাকেন। তাদের বাসায় গিয়ে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, দেয়ালে জাতির পিতার ছবি টাঙানো আছে। কাকতালীয়ভাবে তখন আমার বাসার দেয়ালেও জাতির পিতার ছবি টাঙানো ছিল। সেই ছবি পুরনো হয়ে গেছে, সে জায়গায় আজও আমার বুকশেলফের তাকে টাইলসে অঙ্কিত বঙ্গবন্ধুর ছবি শোভা বিস্তার করে। এটা আছে,এটা থাকবে।

ঢাকা কাস্টম হাউসে চাকরির পর তাঁর সঙ্গে আমার আর কাজ করার সুযোগ হয়নি। আবার এত বছর পর তাকে রাজশাহীতে আমার কমিশনার হিসেবে দেখে মনটা খুশি হয়ে উঠল। তিনি আসার পরপরই সিপাই ও মিনিস্টিরিয়াল স্টাফ নিয়োগের একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আমি ও আমার সদর দপ্তরের টিম রাতদিন পরিশ্রম করে আবেদনপত্র বাছাই, ইন্টারভিউ কার্ড ইস্যু, রাজশাহীর বিভিন্ন স্কুলে চাকরিপ্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ভাইবা পরীক্ষা শেষে বোর্ডে ফলাফল টাঙানো শেষ করলাম। মনে মনে ভাবলাম, দু-একদিনের মধ্যেই কমিশনার স্যারের সঙ্গে কথা বলে জেনে নেব প্রিভেন্টিভ কাজ নিয়ে তাঁর নতুন কোনো নির্দেশনা আছে কিনা!
সেই রাতে মেসে রাতের খাবারের টেবিলে বসে খবর পেলাম কমিশনার এখনও অফিস করছেন। অন্যসময় হলে কমিশনার অফিসে থাকলে অন্য সবাই চলে গেলেও সদরদপ্তরের সুপারকে থাকতে হয়,এটা অলিখিত নিয়ম। আজ তো তিনি বের হয়ে যাওয়ার পর আমরাও অফিস ত্যাগ করি। কমিশনার সন্ধ্যার পরে অফিসে গিয়েছেন, এস্টাবলিশমেন্টের ক্লার্ক রতন মৈত্র আর কম্পিউটার অপারেটরকে সঙ্গে নিয়ে। আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয়না যে আজ হয়তো কোনো বদলি আদেশ হতে যাচ্ছে।

আমি তো নিশ্চিত নির্ভাবনায় রাতের খাবার খেয়ে টিভির সামনে গিয়ে বসলাম। এরইমধ্যে আমার কয়েকজন উদ্বিগ্ন কলিগের ফোন আসে কমিশনারেটের বিভিন্ন স্থান থেকে। স্বাভাবিক কারণেই তারা ভাবেন,সদর দপ্তরে কিছু ঘটনা ঘটলে আমি তা জানব।

মাঝরাতে হেডকোয়ার্টারের সিপাই পোস্টিং অর্ডার নিয়ে আমার কাছে আসে। অর্ডার দেখে আমি চমকে উঠলাম। সুপারিন্টেন্ডেন্টের বদলি আদেশ, সে আদেশে আমার নাম সবার উপরে। আমাকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে বগুড়া সার্কেল-১ এ।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট বাকী তখন মুখ খোলেন। তিনি নাকি জানতেন, এই আদেশটা হবে। বগুড়া-১ পোস্টিংয়ের জন্য অনেক তদবির হয়েছে। আমার জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে জিয়াউর রহমানকে।

এমন পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। পরদিন সকালে কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে বললাম, স্যার, আপনার সাহচর্যে থাকতে পারলেই আমার ভালো লাগত।
কমিশনার হেসে বললেন, সদর দপ্তরের চাকরি হলো সবাইকে তোয়াজ করে চলার চাকরি। আমি তো আপনাকে জানি,সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। শোনেন, কারো সঙ্গে আলাপ করার দরকার নেই। আমার অন্য কোথাও চলে যাবার সম্ভাবনা আছে। যাওয়ার আগে আপনাকে একটা ভালো জায়গায় দিয়ে যেতে চেয়েছি। সার্কেলের চাকরি তো ভালো। সেখানে আপনিই রাজা। কাজ করার অনেক সুযোগ, বিশেষ করে বগুড়া সার্কেল হলো রেভেনিউ পয়েন্ট অব ভিউতে সবচেয়ে ভাইটাল সার্কেল। আমি খবর নিয়েছি, রেভেনিউ বাড়াবার অনেক স্কোপ সেখানে। আমি জানি আপনি সফল হবেন।

রাতে জানলাম, বগুড়া-১ সার্কেলের জন্য অনেকগুলো তদবির হয়েছে। বাকী ভাই নিজেও তদবির করিয়েছেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কাকে দিয়ে বলিয়েছি।
আমি একটু ডাট মেরেই বললাম,আমি নিজেই বলেছি।

বাকী ভাই বিস্ময়ভরা চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি তাকে বগুড়ার দই আর মহাস্থানের ঘি-ভাজা কটকটির দাওয়াত দিলাম।

পরদিন আমি বগুড়া চলে গেলাম। প্রশাসনিক জেলা বগুড়াকে দুইভাগ করে বগুড়া সার্কেল-১ ও বগুড়া সার্কেল-২ গঠন করা হয়েছে। বগুড়া শহর ও সদরের দুই-তৃতীয়াংশ আর কাহালু,গাবতলি ও সোনাতলা উপজেলা আমার জুরিসডিকশন। বগুড়া শহর হলো উওরবঙ্গের ব্যবসা-বাণিজ্যের হাব। ছোট বড় ইন্ডাস্ট্রির সংখ্যাও কম নয়। কমিশনার স্যার ঠিকই বলেছেন রেভেনিউ বাড়াবার অনেক স্কোপ আছে। কীভাবে রেভেনিউ বাড়াতে হয়, সেই কৌশল আমি আগের কমিশনার স্যারের সঙ্গে কাজ করে শিখেছি। আমি সবসময় মনে রাখতাম, ‘ইন্টিগ্রিটি’র কথা,আমার সফলতার কারণ হয়ে ওঠে সেটা। আমার সফলতার পেছনে আরো দুজন মানুষের ভূমিকা ছিল। মৃণাল সরকার নামে এক তরুণ ইন্সপেক্টর ও নজরল ইসলাম নামের একজন বয়স্ক সিপাই। তারা দুজন সার্বক্ষণিক আমার প্রতিটি প্ল্যান বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। বয়স্ক মানুষ বলে নজরুল ইসলামকে আমি নজরুল ভাই ডাকতাম। আমার রেভেনিউ চার্টের উলম্বন দেখে পরবর্তী রেভেনিউ মিটিংয়ে কমিশনার আমাকে স্পেশাল থ্যাঙ্কস জানালেন।

আমাদের বগুড়া কাস্টমস কমপ্লেক্স সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। ঢাকা থেকে রংপুর যাওয়ার সময় বগুড়া শহরের উপকন্ঠে প্রধান সড়কের পাশেই বিশাল দেওয়াল ঘেরা সবুজ গাছপালা শোভিত আমাদের কাস্টমস কমপ্লেক্স। বাংলাদেশে এরকম সুন্দর কাস্টমস কমপ্লেক্স আর একটিও নেই। একই বাউন্ডারির ভেতর অফিস ভবন এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাসাবাড়ি। অফিস ভবনে বিভাগীয় কর্মকর্তা, বগুড়া সার্কেল-১ ও ২ এর সুপারিন্টেনডেন্টের কার্যালয় অবস্থিত। বড় পরিসরে বিভাগীয় কর্মকর্তার বাসভবন, সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও ইন্সপেক্টরের জন্য দোতলা ভবন এবং সিপাই কোয়ার্টার রয়েছে। যেহেতু বগুড়া শহরের অবস্থান বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের মাঝামাঝি এবং হাব হিসেবে পরিচিত ছিল, সে কারণে এখানেই কালেক্টরের কার্যালয় করার ভাবনা থেকে এই কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। পরে হয়তো এ পরিকল্পনা পরিবর্তন হয়ে যায়। এখনো দুটি অব্যবহৃত ভবন পড়ে আছে। পেছন দিকে আছে বিশাল দিঘি। দিঘির পাড়জুড়ে উঁচু বৃক্ষ আর জঙ্গলে পূর্ণ। কেউ এখন আর সেদিকে যায় না সাপের ভয়ে।

অফিস ভবনের সামনে সুন্দর ফুলের বাগান। চারদিকে দেওয়ালঘেরা কমপ্লেক্সটি উঁচু উঁচু বৃক্ষের ছায়ায় সুনিবিড়। তো এই কমপ্লেক্সের একটা দোতলা বাড়ির দোতলায় আমার বাসস্থান হলো। একেকটা বাড়িতে চারটা করে ফ্ল্যাট। আমি একটা ফ্ল্যাট নিয়ে একা থাকি,অন্য ফ্ল্যাটগুলোতে আমার ইন্সপেক্টররা থাকেন। বগুড়া -২ এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট আকরাম ক্যাম্পাসে থাকেন না,তিনি শহরের একটা হোটেলে থাকেন।

বগুড়ার চাকরিজীবন নিয়ে অকারণ টেন্স করার কিছু ছিল না।ট্যাক্সপেয়াররা ছিলেন আইন-অনুগত এবং যথারীতি সরকারি কর পরিশোধ করতেন। কমিশনার স্যার আমার পারফরম্যান্স নিয়ে খুশি ছিলেন।

একদিন ‘কনফিডেনসিয়াল’ সিলমারা একটা খাম এলো। কমিশনার আমাকে বিশেষ একটা ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেছেন। জয়পুরহাট সার্কেলের এক অফিস সহকারীর বিরুদ্ধে এক বিবাহিত নারীর বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করার নির্দেশনা। অভিযোগটি এসেছে ওই নারীর পিতার পক্ষ থেকে, যেখানে তিনি কমিশনার বরাবরে নিজ কন্যার বৈবাহিক জীবন নিরাপদ রাখার নিমিত্তে এই অভিযোগ করেছেন। পত্রে তিনি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, ওই ব্যক্তি নিজেকে গ্রাজুয়েট বললেও তিনি খবর নিয়ে জেনেছেন অভিযুক্ত ব্যক্তি ডিগ্রি পাশ করেন নি। এখানে সঙ্গত কারণেই অফিস সহকারীসহ সংশ্লিষ্টদের নাম-পরিচয় গোপন রাখা হলো। অফিস সহকারীর কল্পিত নাম ধরা যাক, ‘ক’।

একদিন পর আমার বিশ্বস্থ ইন্সপেক্টর মৃণালকে সঙ্গে নিয়ে জয়পুরহাট গেলাম এবং অভিযোগকারী ভদ্রলোককে খুঁজে বের করলাম। তিনি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি একটা পাঁচতলা ভবনের মালিক এবং বাড়ির একটা ফ্ল্যাটে বসবাস করেন।

আমি তাঁর কাছে অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলাম।

তিনি জানালেন, তাঁর মেয়ে জামাই পুলিশের এএসআই। বদলিজনিত কারণে বিভিন্ন জায়গায় থাকেন।বর্তমান পোস্টিং ঢাকায়। তার মেয়ে তার এই বাসাতেই থাকে,বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার সুবিধা আছে বলেই তারা এখানে থাকে। তার ক্লাস নাইন পড়ুয়া কন্যা ও ক্লাস সিক্স পড়ুয়া ছেলে আছে। ছেলে-মেয়েকে স্কুলে আনা-নেওয়ার পথে কাস্টমসের ওই কর্মচারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং অনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয় । এটা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। স্কুলে যাওয়ার পথের পাশেই কাস্টমসের অফিস। অফিসের নিচতলায় কয়েকজন স্টাফ থাকে। সেই কর্মচারীও সেখানে থাকে।
বললাম, এটা জানার পর আপনার মেয়েকে আপনি বোঝান নি?

বয়স্ক ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই আহত কন্ঠে জানালেন, এই পথ থেকে ফিরে আসার কথা বলায় সে বলে,পুলিশ ঘুষ খায়। ঘুষখোর পুলিশের সঙ্গে সে সংসার করবে না। আপনাদের স্টাফ নাকি অফিসের ইউডি। কিছুদিন পরই সে অফিসার হবে,সে তাকে নিয়েই সংসার করবে। মেয়েকে তার ছেলে-মেয়ের কথা বলে এই পথ থেকে ফিরতে বলায় সে তার হাতে থাকা গ্লাস ছুড়ে মারে, সেটা মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়,গ্লাসের ভাঙা টুকরো বৃদ্ধ বাবার চোখে এসে বেঁধে। অনেকেদিন তিনি চোখের ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। মেয়েকে ফেরাতে না পেরে বাধ্য হয়ে তিনি এই অভিযোগ করেছেন।
মেয়েকে ডাকুন। আমি বললাম।
ভদ্রলোক বললেন, এখন স্কুল বন্ধ। তাই বাধ্য হয়ে স্বামীর বাসায় গেছে। স্বামীর বাসা ঢাকার খিলখেতে।
বললাম, তার সঙ্গে তো কথা বলা দরকার।
সেটা কী না করলেই নয়?
তা কেন?

আমি যে কমপ্লেইন করেছি, জানতে পারলে আমাকে আবার নির্যাতন করবে।
কিন্তু তার সঙ্গে যে কথা বলতেই হবে! দোষ তো আর আমার স্টাফ একা করেনি,আপনার মেয়েও সমান দায়ী। তার সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে। আমি আপনার কমপ্লেইনের ব্যাপার গোপন রাখব,তাকে বলেন,সরকারি ইনকোয়ারি,তাকে ফেস করতে হবে, প্রয়োজন পড়লে তার স্বামীকেও ডাকা হবে।

আমার কথায় ভদ্রলোক চমকে উঠলেন। বললেন, না না, তাকে ডাকবেন না। মেয়ের সংসার রক্ষার জন্যই তো এতকিছু!

আমি একজন বাবার মনের কষ্টকে অনুভব করি। বললাম, আমি তাকে ডাকব না। আপনার মেয়েকে ইনকোয়ারি ফেস করানোর জন্য এটা একটা কৌশল।

এরপর আমি গেলাম জয়পুরহাট সার্কেল অফিসে। প্রথমে আমি সেখানে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে কাউকে কিছু বললাম না। তাদের অতিথি আপ্যায়ণের একপর্যায়ে সুপারিন্টেন্ডেন্টের কানে কানে আমার আগমনের কারণ বললাম। তিনি যা বললেন তা শুনে তো হতভম্ব হয়ে গেলাম। বললেন,’ক’এডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন এমএলএসএস। তিনি বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক। সে পড়াশোনায় ভালো। মিনিস্ট্রিয়াল স্টাফের শর্টেজ বলে অফিসের অনেক ক্লারিক্যাল কাজকর্ম সে করে।

আমি খুব গোপনীয়তার সঙ্গেই তার পার্সোনাল ফাইল দেখলাম। সেখানে কেবল তার এসএসসি পাশ সার্টিফিকেটের সত্যায়িত ফটোকপি আছে। আমি সার্টিফিকেটের একটা ফটোকপি সঙ্গে নিয়ে এলাম।

পরদিন আমার অফিসে একজন সঙ্গীসহ ‘ক’ এলো। নিজেকে সে নিরপরাধ দাবি করে। আমার পায়ে পড়ে সে বারবার কসম করে বলতে থাকে, যে অপরাধে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সে অপরাধ সে করে নি। আমি যেন তার চাকরিটা রক্ষা করি।
বললাম, অপরাধ না করলে আমি তোমার বিরুদ্ধে এক কলমও লিখব না।
কিন্তু আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, যে চিঠিটার খামে ‘কনফিডেনসিয়াল’ সিল মারা আছে, অথবা এত সতর্কতা নিয়ে জয়পুরহাট অফিসে তদন্ত করলাম,কিছুই তো আার ‘গোপনীয়’ থাকছে না। আমি অবশ্য ‘ক’-কে কিছু বললাম না।
আমি মৃণালকে পাঠালাম তার গ্রামের বাড়ির ঠিকানয়। মৃণাল খবর নিয়ে এলো,’ক’ বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক।
আমার বন্ধু কবি ও ভাষাবিজ্ঞানী ডক্টর সালিম সাবরিন তখন রাজশাহী বোর্ড কলেজের প্রিন্সিপাল। তাকে বললাম রাজশাহী বোর্ডে আমার এক কর্মচারীর সার্টিফিকেট ভেরিফাই করাতে চাই। তিনি বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জানালেন, তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে চেয়ারম্যানকে অ্যাড্রেস করে আবেদন করলে তিনি তাৎক্ষণিক কাজটা করে দিবেন।
আমি রাজশাহী বোর্ডে গেলাম। সংশ্লিষ্ট বছরের রেজাল্ট রেজিস্টার দেখে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। তার নামের পাশে অকৃতকার্য লেখা আছে।

আমি অভিযোগকারী ভদ্রলোককে ঢাকায় তার মেয়ের সঙ্গে জরুরি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে বললাম। পরবর্তী সাপ্তাহিক ছুটির দিনে একটা ফাস্টফুডের দোকানে মেয়েটার সঙ্গে আমার দেখা হলো। তিনি সুন্দরী এবং তার সঙ্গে কথা বললে পুরুষের ভালোলাগার ব্যাপারটি ঘটতেই পারে। আমরা কথা বলছিলাম তার বাবাকে সামনে রেখেই। তিনি সবকথা স্বীকার করলেন এবং ‘ক’-কে পাওয়ার জন্য তার অনড় সিদ্ধান্তের কথা জানালেন।

আমি মেয়েটাকে একঘন্টা ধরে কাউন্সেলিং করলাম। তার সন্তানদের কথা বললাম। তারা যদি এসব জানে তাহলে চিরকাল মা-কে তারা ঘৃণা করবে। ঘুষ খাওয়া প্রসঙ্গে বললাম, ‘ক’ নিজেও ঘুষ খায়। বললাম, নিজের চাকরি সম্পর্কে সে মিথ্যা কথা বলেছে। সে খুব নিম্নপদে চাকরি করে, কখনো অফিসার হতে পরবে না। সবচেয়ে বড় কথা, সে বিবাহিত এবং সন্তানের বাবা,যা সে আপনার কাছে গোপন করেছে।

ইচ্ছে করেই আমি সার্টিফিকেট সম্পর্কে কিছু বললাম না। কারণ, রিপোর্ট দাখিলের আগেই যেন বিষয়টি ফাঁস হয়ে না যায়!

আমার মনে হলো,আমি মেয়েটিকে বোঝাতে পেরেছি। আমি তার স্বামীর উজ্জ্বল ভবিষ্যত সম্পর্কে ধারণা দিলাম। পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হওয়ার মধ্যে একটা ‘ভাব’ থাকে, এটা শুনে তিনি হেসে ফেললেন। জয়পুরহাটের বাসায় আমি দেয়ালে টাঙানো তার স্বামীর ছবি দেখেছিলাম। আমি যখন তুলনা করে বললাম যে কাস্টমস থেকে পুলিশ সুন্দর, তিনি আবার হাসলেন। বললাম, এমন সুন্দর সুপুরুষ স্বামী ফেলে কেউ ওরকম কদাকার মানুষের বন্ধু হয়!
তাকে বললাম,আপনি আর কখনো জয়পুরহাটে থাকতে যাবেন না, যত কষ্টই হোক, স্বামীর সঙ্গে থাকবেন।

আমি যখন বিদায় নিচ্ছি, মেয়েটা আমার পা ছুঁয়ে সালাম করল। একটা অনুরোধও করল,আমি যেন ‘ক’-র কোনো ক্ষতি না করি।

কিন্তু আমি তার কথা রাখতে পারিনি। তদন্ত প্রতিবেদনে আমি তাদের অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে গেছি। সার্টিফিকেট জাল করার বিষয়টি উল্লেখ না করা আমার এথিকস্ বিরোধী। আমি সে বিষয়ে বিস্তারিত লিখলাম। আমার উচিত ছিল তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কারের প্রস্তাব করা। কিন্তু আমি সেটা করলাম না।

তদন্ত রিপোর্ট আমি কমিশনার স্যারকে হাতে হাতে দিলাম। যে-কথাগুলো আমি রিপোর্টে বর্ণনা করিনি,সে-গুলো তাঁকে মুখে বলেছি। দুজন মানুষের ব্যক্তিগত গোপন জীবন আর দুটো পরিবারের সম্মান বাঁচাবার জন্যই আমি সেসব উল্লেখ করিনি বলে স্যারকে বললাম। কমিশনার আমার তদন্ত রিপোর্টের প্রশংসা করে বললেন, আমি জানতাম,এই তদন্তটা আপনিই ঠিকভাবে করতে পারবেন,সেজন্য অন্য কাউকে দায়িত্ব দিইনি।

অবশ্য রিপোর্টে শাস্তির বিষয়ে প্রস্তাব না করায় তিনি রিপোর্টকে অসম্পূর্ণ বললেন।
তাৎক্ষণিকভাবে ‘ক’-কে তিনি চাকরি থেকে বহিষ্কার করলেন এবং সদর দপ্তর সুপারিন্টেন্ডেন্টকে জাল সাটিফিকেট দাখিল করে চাকরি নেওয়ার অপরাধে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশনা দিলেন।

সেই সন্ধ্যায় বোয়ালিয়া থানায় ‘ক’ এর নামে মামলা দায়ের হলো। আমি বগুড়া ফিরে গেলাম সত্য,কিন্তু আমার নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত হয়ে উঠল আমার সহকর্মীরা। পরপর কয়েকদিন রাতের শিফটে ডিউটি করা সিপাইরা কোনো অপরিচিত ব্যক্তিকে কাস্টমস কমপ্লেক্সে প্রবেশ করতে দিল না।

- Advertisement -

Latest Posts

Don't Miss

Stay in touch

To be updated with all the latest news, offers and special announcements.