গত শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ৯টায় কানাডার জাতীয় গণমাধ্যম সিবিসি (কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন) টেলিভিশনের ‘দ্য ফিফ্থ এস্টেট’ অনুষ্ঠানে ‘দ্য অ্যাসাসিন নেক্সট ডোর’ অর্থাৎ ‘ঘরের পাশে খুনি’ শিরোনামে টরন্টোয় আশ্রিত ও বঙ্গবন্ধু হত্যায় মৃত্যুদন্ডের আসামী এস এইচ এম বি নূর চৌধুরীকে নিয়ে প্রায় ৪৩ মিনিটের এক আগ্রহদ্দীপক অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্র সম্প্রচার করেছে।
এতে ওই অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্রের পটভূমিতে একাধিক সম্মাননাজয়ী উপস্থাপক মার্ক কেলী সরাসরি টরন্টোর পশ্চিমাংশে বসবাসকারী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নেতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যায় মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত নূর চৌধুরীর মুখোমুখি হয়ে কানাডার বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন – ‘হোয়ার ইজ আওয়ার জাস্টিস সিস্টেম?’ একই সঙ্গে বাংলাদেশের অশ্রুসজল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং কানাডায় নিয়োজিত ও সিবিসি’র প্রতিবেদনে অভিহিত ‘ম্যান ইন এ মিশন’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. খলিলুর রহমানের একান্ত আকুতিটিও তুলে ধরেন।
দেখা গেল প্রথমবারের মতো চাক্ষুষ নূর চৌধুরীকে তার অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় ফুলের বাগানের পরিচর্যায়, এমনকী প্রামাণ্যচিত্রের উপস্থাপক মার্ক কেলী আপাতদৃষ্টিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে সাদা রঙের একটি ‘এসইউভি’ চালিয়ে দ্রুত সটকে পড়া হতচকিত নূর চৌধুরীর মুখোমুখি হন। তাতে নূর চৌধুরীর মুখে ‘জাস্ট এ সেকেন্ড’ ব্যতীত কোনো প্রত্যুত্তর না পেলেও অতীতে সিবিসি রেডিওতে প্রদত্ত সাক্ষাতকার ও ম্যাকলিন’স ম্যাগাজিনে তাকে নিয়ে যথাক্রমে সম্প্রচারিত ও প্রকাশিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষটি উপজীব্য করেন। যাতে নূর চৌধুরীর মুখ্য বক্তব্যটি ছিল- আমি নির্দোষ। আমি প্রেসিডেন্টকে হত্যা করিনি, সেজন্যই আমি আজ কানাডায়; আমাকে জড়ানো হয়েছে, আমি কানাডা সরকারের কাছে সুবিচার ও সুরক্ষা চাচ্ছি।
তথাপি ধারণা করা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সিবিসি টেলিভিশন সম্প্রচারিত ওই প্রামাণ্যচিত্রের কারণে বাংলাদেশ সরকারের সুদীর্ঘ ২০০৯ সাল থেকে চলমান একচ্ছত্র প্রয়াসের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ধোঁয়াশা অনেকাংশেই কেটে গেছে। কেননা তার বিচারের যুক্তিসঙ্গত দলিল-দস্তাবেজ সিবিসি’র উপস্থাপক মার্ক কেলী স্বয়ং ঢাকায় গিয়ে সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া এ বিষয়ে কানাডার সাবেক জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী স্টকওয়েল ডে এবং ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের অধ্যাপক রবার্ট জে কারির দায়িত্বশীল অভিমতও গ্রহণ করেছেন।
পাশাপাশি ওই প্রামাণ্যচিত্রে নূর চৌধুরীর কানাডায় পালিয়ে আসা, অব্যাহতভাবে ২৭ বছর এ দেশে অভিবাসন আইন লড়ে অবস্থান করা এবং পক্ষান্তরে খুনের অভিযোগে দন্ডিত শাস্তি কার্যকরে তাকে বাংলাদেশের ফেরত চাওয়ার বিষয়গুলো ওঠে এসেছে। এক্ষেত্রে কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. খলিলুর রহমান বলেন, এই ইস্যুটি বাদে কানাডার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। কেবল বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নয়, বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি চাই তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হোক।
তদুপরি নূর চৌধুরী প্রসঙ্গে প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়, তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যার পর কূটনীতিক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তিনি পালিয়ে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র, পরে কানাডায় দর্শনার্থী ভিসায় আসেন। এরপর ১৯৯৯ সালে শরণার্থী হিসেবে থেকে যাওয়ার আবেদন করলে কানাডা সরকার তা নাকচ করে দেয়। পরিণতিতে আপিল করেও অনুকূল রায় পাননি। এরপর ২০০৯ সালে কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে ডিপোর্টের নির্দেশ দেয় অভিবাসন ও শরণার্থী কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশে পাঠালে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হতে পারে এমন শঙ্কার কথা জানিয়ে ২০১০ সালের দিকে সরকারের কাছে ‘প্রি-রিম্যুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’-এর আবেদন করেন নূর চৌধুরী। যেহেতু কানাডা মৃত্যুদন্ড সমর্থন করে না, সেহেতু সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি পরবর্তী প্রায় ১৪ বছর ধরে দেশটিতে রয়েছেন। সেটাই সবিশেষভাবে উন্মোচিত হয়েছে সিবিসি’র ওই প্রামাণ্যচিত্রে। এখন দেখার পালা তিনি আদৌ কানাডায় থাকতে পারেন কিনা?