কানাডার নাগরিকত্ব ও অভিবাসন আইনের ‘ইনঅ্যাডমিসিবিলিটি’ বা প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ উপধারায় ৩৪ থেকে ৩৭ অনুচ্ছেদে কাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেশটিতে আসার বা থাকার অনুমতি দেবে, তা বিশদভাবে বর্ণিত। সেক্ষেত্রে অবশ্যই নিষেধাজ্ঞা আরোপিত কোনো সন্ত্রাসী দলের সদস্য কিংবা সম্পৃক্ত ব্যক্তির জন্য ‘থাকা’ তো দূরের কথা ‘আসা’ই পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একমাত্র গত ৫ বছরেই কানাডায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সংক্ষেপে বিএনপি’র কমপক্ষে দুই ডজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এসেছেন, যাদের মাঝে সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দরা রয়েছেন।
ফলে ২০১৭ সাল থেকে বিএনপি নামধারী জনৈক মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজীর শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়প্রার্থনার আবেদন নাকচ হওয়াকে কেন্দ্র করে ওই রায়ের আইনগত উপাদান না বুঝেই দেশীয় কতক গণমাধ্যমে রটেছে- ‘বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল।’ অথচ দলটির উল্লেখিত নেতৃবৃন্দরা আজও কানাডায় অনায়াসে অব্যাহতভাবেই যাতায়াত করেন। এমনকী ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর তৎকালীন কানাডার নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী রাল্ফ গোদেলও এক আনুষ্ঠানিক পত্রে স্বয়ং নিশ্চিত করেন যে, ‘দ্য বিএনপি ইজ নট অ্যান্ড হ্যাজ নেভার বিন লিস্টেড অ্যাজ এ টেরোরিস্ট এনটিটি আন্ডার দ্য ক্রিমিনাল কোড রেজিম’, অর্থাৎ কানাডার ক্রিমিনাল কোড অনুসারে বিএনপি কখনোই সন্ত্রাসী দলভুক্ত ছিল না, যা তার আওতাধীন।’ ভিন্নভাবে, বিএনপি যদি সন্ত্রাসী দলই হবে, তাহলে কেন কানাডার রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বাংলাদেশে দলটির নেতৃবৃন্দ দেখা বা বৈঠকে বসেন; উপরন্তু তারাই কেন আপাতদৃষ্টিতে বিএনপি’র পক্ষে নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে ওকালতি করেন?
আদতে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি প্রধান বিরোধী দল হওয়ায়, কিংবা ভিন্নভাবে অতীেেত যখনই যে দল বিরোধী অবস্থানে থেকেছে, সেটির গতানুগতিক সুযোগ নিয়েছেন আশ্রয়প্রার্থীরা। এখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আদৌ দল বা রাজনীতি করেছেন কিনা তা মুখ্যভাবে তদন্তের পরিবর্তে দলের বিষয়ে যথেষ্ট ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য। কালক্রমে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কানাডা অভিবাসন নিয়ামাবলীকে প্রতিনিয়ত বদলেছে কিংবা আমরাই নানাভাবে তাদের সামর্থ্যবান করে তুলেছি। সেজন্য গত ১৫ বছরে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থনার দৃশ্যপটটি পাল্টেছে। এখন ‘অচেনা’ যারাই কানাডায় বিএনপি কর্মী হিসেবে আবেদন করেছেন, তাদেরকে দুই শতাধিক পৃষ্টার দলিল-দস্তাবেজ সংবলিত বিষয়ে সন্তুষ্টিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে হয়; যেখানে বিএনপি’র বিরুদ্ধে প্রচারিত ঋণাত্মক (নেগেটিভ) সংবাদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্য সরকারের উদ্ঘাটিত নানা বিষয়াবলী থাকে।
আমি নিজে পেশাগত কারণে তা সরাসরি তদন্ত ও প্রত্যক্ষ করেছি, এমনকী কানাডায় যারাই ন্যূনতম অভিবাসনের খোঁজ-খবর রাখেন, তাদের সকলেই বিষয়টি কম-বেশি জানেন। তাই ধারণা করা হয়, ওই দুই শতাধিক দস্তাবেজের প্রতিটির ব্যাখ্যা প্রদান সকলের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। সম্ভবত জুয়েলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কানাডায় তার স্থায়ী অভিবাসনের ক্ষেত্রে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রদত্ত নাকচের রায়ে বর্ণিত হয়েছে- ‘বিলম্বিত দ্বিতীয় ধাপের নিরাপত্তা সংক্রান্ত তদন্তে সে প্রবেশাধিকার বা থাকার ক্ষেত্রে [৩৪(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে] অনুপযুক্ত বিবেচিত হয়।’ এটাই ছিল রায়ে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ডি নোভো’ পন্থা এড়িয়ে বিচারিক মূল্যায়ণে ‘সত্যের পরিবর্তে বিবেচনা’ প্রসূত। তবু বিচারক হেনরি এস. ব্রাউন তাঁর ৩৩ পৃষ্টার রায়ে অভিবাসন কর্মকর্তার মূল্যায়ণ ও বাদী জুয়েলের গুরুত্বারোপের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বলেছেন, ‘…পলিটিক্স্র ইন বাংলাদেশ ইজ এ ভায়োল্যান্ট অ্যাফেয়ার’, অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতিই সহিংস। এতে জুয়েল নিজেই স্বীকারোক্তি দিয়েছে- যদিও ‘বিএনপি সন্ত্রাসী দল নয়’ এবং ‘নেতৃবৃন্দ সর্বদাই সহিংসতাকে নিরুৎসাহিত করে থাকেন।’
অনুরূপভাবে যে কেউ এ সংক্রান্ত পরবর্তীতে প্রদত্ত চারটি রায়ের বিষয়বস্তু গভীরভাবে পড়লে দেখবেন বিএনপি নামধারী শরণার্থী, যেমন- মো. মোস্তাফা কামাল (২০১৮ সালের ৪ মে), মো. মাসুদ রানা (২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর), মো. সেলিম বাদশা (২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর) ও সর্বশেষ মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক (২০২৩ সালের ১৫ জুন), এদের সবার পরিণতি এক, অর্থাৎ আবেদন নাকচ হয়েছে। জনসমক্ষে উন্মুক্ত এই রায় অনলাইনে গুগলের সাহায্যে ‘ফেডারেল কোর্ট অব কানাডা’র ওয়েবসাইটে ‘ডিসিশন ম্যানু’ অপশনে তারিখ ও নাম দিয়ে সার্চ দিলেই পাওয়া যাবে। তবে লক্ষণীয়, সর্বশেষ মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হকের ২৬ পৃষ্টার নাকচ রায়ে বিচারক অ্যান্ড্রু ডি. লিটল দ্বিতীয় পৃষ্টার তৃতীয় অনুচ্ছেদের শেষ লাইনে লিখেছেন, ‘দ্য আইডি [ইমিগ্রেশন ডিভিশন] ডিড নট ফাইন্ড রিজনবল্ গ্রাউন্ডস টু বিলিভ দ্যাট দ্য বিএনপি ওয়াজ অ্যান অর্গানাইজেশন দ্যাট হ্যাড এনগেজড্ ইন টেরোরিজম,’ অর্থাৎ অভিবাসন বিভাগ বিশ্বাসযোগ্যভাবে এমন কিছু পায়নি, যা বিএনপি’র সঙ্গে সন্ত্রাসের যোগসম্পৃক্তি ঘটিয়েছে।
তাই আধুনিক বিশ্বে জনস্বার্থে গণমাধ্যমের সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অক্ষুন্ন রাখতে কোর্টের রায়টি কী বিষয়ে বোঝার জন্য আটটি উপাদান জানা প্রয়োজন, যা ভিন্ন আঙ্গিকেও অভিহিত। যেমন- টাইটেল অব দ্য জাজমেন্ট (রায়গত শিরোনাম), সাইটেশন (রায়গত উদ্ধৃতি), দ্য বেঞ্চ (বিচারিক পর্ষদ), দ্য প্রসিডিউরাল জার্নি অব দ্য মেটার (ঘটনার বিবরণ), দ্য ডিসিশন ইন দ্য লোয়ার কোর্টস বাই এ বেঞ্চ অব লোয়ার ষ্ট্রেন্থ (নি¤œ আদালতের রায়), ডেসক্রিপশন অব দ্য পার্টিজ (বিবদমান পক্ষ-বিপক্ষ), ফ্যাক্টস অব দ্য ডিসপিউট (বিরোধের সত্যাসত্য) ও কনটেনশনস অব দ্য পার্টিজ (পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তিতর্ক)। আর শরণার্থীদের জন্য কানাডায় দীর্ঘমেয়াদী তিনটি ধাপ রয়েছে; যেমন- প্রাইমারি, প্রি-রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট ও হিউম্যানিটেয়িান অ্যান্ড কমপেশনেট গ্রাউন্ড – সেগুলো কদাচিৎ ফলপ্রসূ না হলে তবেই ব্যর্থ প্রার্থীকে কানাডা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।