শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪
5.7 C
Toronto

Latest Posts

জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ

- Advertisement -

সিরাজগঞ্জ শহরে আমার এই প্রথম আসা। এটা কোনো হাইওয়ে বা বড় সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত শহর নয়। ঢাকা-রাজশাহী আর পাবনা-বগুড়া মহাসড়কের ইন্টারসেকশন হাটিকুমরুল মোড় থেকে কড্ডা হয়ে কোনাকোনি ভেতরের দিকে পাঁচ কিলোমিটার গেলে তবে সিরাজগঞ্জ জেলাশহর। আর ট্রেনে গেলে ঢাকা-রাজশাহী রেলপথের ক্যাপ্টেন মনসুর আলী স্টেশন থেকে সড়কপথে সিরাজগঞ্জের দুরত্বও পাঁচ কিলোমিটার।

- Advertisement -

একসময় সিরাজগঞ্জ যমুনা নদীর পাড়ে বড় নদীবন্দর ছিল। কালক্রমে পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে নদীর গুরুত্ব কমে গেলে সড়ক যোগাযোগের গুরুত্ব বেড়ে যায়। সিরাজগঞ্জ শহর সেকারণে মহাসড়কের ব্যস্ততার বাইরে থেকে তার সাবেক মফস্বলি চরিত্র নিয়ে বেশ আছে। আজকাল অবশ্য শহরগুলোকে কোলাহল মুক্ত রাখতে বাই-পাস সড়কের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে।

আগেও বলেছি বগুড়ার মতো খুব কম জায়গাতেই কাস্টমসের নিজস্ব বাড়ি বা অফিস ভবন রয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড়ো বড়ো শহরের পাড়া-মহল্লায় তো বটেই অন্যান্য সব মফস্বল শহরেও বাড়ি ভাড়া করে কাস্টমসের অফিস চলমান রয়েছে। কেবল কাস্টমস বা ভ্যাট অফিসই নয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীন আয়কর ও ইন্টেলিজেন্সের অফিসগুলো ভাড়া বাসায় পরিচালিত হতো। আমার অফিসও সিরাজগঞ্জ শহরের ব্যস্ততম বড়বাজার এসএস রোডের উপর অবস্থিত। নিচে বাণিজ্যিক দোকানপাট থাকলেও দোতলায় বেশ বড়সড় জায়গা নিয়ে সিরাজগঞ্জ সার্কেল অফিস। একসময় এখানকার সার্কেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন আমাদের বন্ধু শফিকুল বারী। আমরা দুজন দুজনকে গেরাই(বন্ধু) বলে সম্বোধন করতাম। তিনি খুবই সৌখিন ও রুচিবান মানুষ ছিলেন। তিনি এই অফিসটি ভাড়া করেছিলেন এবং মনের মতো করে সাজিয়েছিলেন। আমাদের প্রিয় কলিগ ২০২০ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। অফিস থেকে দুইবাড়ি পরেই আরেকটা বাড়ির তিনতলায় আমাদের বাসস্থান। সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও ইন্সপেক্টরগণের জন্য একটাই বাড়ি। সবার জন্য আলাদা আলাদা রুম। একজন বুয়া আছেন, তিনি রান্নাবান্না করেন,ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেন। জরুরি অফিসিয়াল কাজ ছাড়া এখানে একটানা কেউ থাকে না। সবারই পরিবার ঢাকায় থাকে,ছেলেমেয়ের পড়াশোনা আছে। কাজেই দাপ্তরিক বিশেষ কাজে আটকে না থাকলে বৃহষ্পতিবার বিকেলের পরে তাদেরকে আর সিরাজগঞ্জ শহরে দেখা যায় না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নতুন অর্গানোগ্রাম অনুসারে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে কাস্টমস ও ভ্যাট কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটছে, দুই বছর আগে ক্যাডার বহির্ভূত নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদবীও পরিবর্তন হয়েছে। সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদ প্রথমশ্রেণির গেজেটেড ও ইন্সপেক্টর পদবী দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড পদ। যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য, ভারতসহ পৃথিবীর সব দেশেই সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও ইন্সপেক্টর পদবী বিদ্যমান। কিন্তু সরকার বাজেট প্রস্তাবনায় পদ দুইটিকে যথাক্রমে রেভেনিউ অফিসার (রাজস্ব কর্মকর্তা), এসিস্ট্যান্ট রেভেনিউ অফিসার (সহ. রাজস্ব কর্মকর্তা) নামকরণ করেছে। পাকিস্তানেও এই পদবীর নাম পরিবর্তন করে রেভেনিউ অফিসার ও এসিস্ট্যান্ট রেভেনিউ অফিসার করা হয়েছে। এ-নিয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমত, ক্ষোভের কারণ হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, আমাদের এমনটা মনে হতে থাকে সুপারিন্টেন্ডেন্ট বা ইন্সপেক্টরগণ কেবল রাজস্ব আদায়ের কাজই করে না,একই সঙ্গে তারা অ্যাপরাইজমেন্ট, গোয়েন্দা ও প্রিভেন্টিভ কার্যক্রমও পরিচালনা করে থাকেন। সুপারিন্টেন্ডেন্ট এডজুডিকেশন করেন। কাজেই রাজস্ব কর্মকর্তা বলে তাদের মর্যাদাকে খাটো করা হয়েছে। কাগজে কলমে আর ও (রেভেনিউ অফিসার),এ আর ও ( এসিস্ট্যান্ট রেভেনিউ অফিসার ) লেখা হলেও প্রশাসনের সর্বত্র তারা সুপারিনটেনডেন্ট ও ইন্সপেক্টর হিসেবেই সম্বোধিত হতে থাকেন। এই ঘটনার প্রায় একযুগ পর যখন আমি এই ঘটনার কথা লিখছি, তখনও অবস্থা একইরকম বিরাজ করছে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনও তাদের বিলুপ্তকৃত পদের জন্য আন্দোলন অব্যাহত আছে। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় সংবাদ দেখা যায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পূর্বতন পদ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সহসাই আদেশ জারি করতে যাচ্ছে, হয়তো একদিন জারি হয়েও যাবে।
নতুন অর্গানোগ্রামে রাজশাহী কমিশনারেট ভেঙে রংপুর হয়েছে, সিরাজগঞ্জের দায়িত্ব পালন করতেন একজন সুপারিন্টেন্ডেন্ট, তারও আগে একজন ইন্সপেক্টর। এখন সেখানে একজন বিভাগীয় কর্মকর্তা এসেছেন, ভবিষ্যতে হয়তো সিরাজগঞ্জ সার্কেল ভেঙে আরো সার্কেল হবে। বিভাগীয় কর্মকর্তার অফিস কাম রেসিডেন্স করার জন্য শহরের ভাসানী রোডে একটা বড়ো বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের নয়টি উপজেলা সিরাজগঞ্জ সদর,কামারখন্দ, কাজীপুর, রায়গঞ্জ, তাড়াশ, বেলকুচি,চৌহালি,উল্লাপাড়া,শাহজাদপুরকে চারটি রেঞ্জে ভাগ করে চারজন এ আর ও-র মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে দেওয়া হলো।
আমার রাজশাহীর টেনিউর শেষ হয়ে আসছিল। রাজশাহীর মতো সিরাজগঞ্জেও অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। কাজেই আমি সময়টাকে কাজে লাগাতে চাইলাম। আমার সিপাই আবু সাইদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ শহরে। বয়সে তরুণ। তাকে ও ইন্সপেক্টর শাহজাহানকে সঙ্গে নিয়ে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে চলে যাই। কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর বাড়ি ও তার মাজার সিরাজগঞ্জ শহরের সরদার পাড়ায়। আমি আবু সাইদকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর সুন্দর বাড়ি ও মাজার দেখে আসি। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর বংশধর। তাঁর পূর্ব পুরুষ ইরাণ থেকে এসেছেন এবং মোঘল দরবারে চাকরি করতেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজী ব্রিটিশ যুগে মুসলিম নব জাগরণের একজন সংগঠক ও বাগ্নীনেতা ছিলেন। তাঁর বড়ো পরিচয় তিনি একজন কবি ও লেখক। তাঁর ‘অনল-প্রবাহ’ কবিতাগ্রন্থে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের অভিযোগ উঠলে ব্রিটিশ সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করে এবং তাঁকে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে (কাব্য)- অনল-প্রবাহ,আকাঙ্খা, নব উদ্দীপনা, উদ্বোধন, (উপন্যাস)-রায়নন্দিনী, তারাবাঈ, ফিরোজা বেগম, নুরউদ্দীন,জাহানারা।
সিরাজগঞ্জের একটা পর্যটন অঞ্চল হলো যমুনা নদীর পাড়ে হার্ড পয়েন্ট। প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রচুর মানুষ সেখানে বেড়াতে আসে। একসময় সিরাজগঞ্জ শহর যমুনা নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে এবং বিশাল এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তখন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কোরিয়ার হুন্দাই ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কারিগরি তৎপরতায় সে ভাঙন বন্ধ করা হয়।

নদী শাসনের ফলে বিশাল নদীপার এখন পর্যটন জোনে পরিণত হয়েছে। ইন্সপেক্টর শাহজাহানকে সঙ্গে নিয়ে কোনো কোনো দিন বিকেলে ইলিয়ট ব্রিজ পার হয়ে হার্ডপয়েন্টে চলে যাই। বিকেলবেলা নদী থেকে শীতল হাওয়া ভেসে আসে,ছোট ছোট স্পিডবোটে চড়ে উৎসাহী যুবকেরা নদীর স্রোতের বিপরীতে জল ছিটিয়ে দৃষ্টি সীমার বাইরে ছুটে যায়। এখানে বিশাল প্রচ্ছদপটে বহুদূর পর্যন্ত যমুনার জলরাশি চোখে পড়ে। সূর্যাস্তের লাল ঝিলমিল জলের শরীরে কাঁপতে থাকে। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ভোরের সূর্যোদয়ও দেখা যায়। আমার সুর্যোদয় দেখার সুযোগ হয়নি। সুর্যাস্ত দেখতে আসা পর্যটকদের মন্তব্য শুনি,যমুনার সূর্যোদয় আরও সুন্দর। বিকেলের আকাশটা অদ্ভুত সুন্দর। আকাশ যেন যমুনার আয়না। সেখানে পাতলা মেঘের ওড়নায় লুকোচুরি খেলে বিকেলের চাঁদ। ঝটপট ছবি তুলি মোবাইলের ক্যামেরায়।

বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পারে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ইকো পার্ক। এক শুক্রবার বিকেলে আবু সাইদকে নিয়ে ঘুরে এলাম ইকো পার্কে। সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষাবাঁধ যমুনা নদীর পাড় ঘেষে এই ইকো পার্কের পাশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু ব্রিজ পর্যন্ত চলে গেছে। ইকো পার্কের বাইরের দিকে সেই বাঁধ ধরে হাঁটার অভিজ্ঞতা সত্যি অন্যরকম, রাজশাহী বা ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ট্রেনগুলোকে তখন মনে হয়, অনেক উপর দিয়ে বিশাল লম্বা ট্রেনটা শুন্যে ভেসে চলেছে।

শাহ সুফি খাজা ইউনুস আলী স্মরণে তাঁর জামাতা আমজাদ আলি সাহেব চৌহালি উপজেলায় নির্মাণ করেন খাজা ইউনুস আলী হাসপাতাল ও কলেজ। নগরজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এই হাসপাতালের নির্মাণশৈলি বাংলাদেশের যে কোনো হাসপাতাল থেকে সুন্দর। কেবল কাঠামোগত দিক দিয়ে নয়,এর উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত যে-কোনো দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সমতূল্য। দাপ্তরিক কাজেই গিয়েছিলাম হাসপাতালে, কিন্তু এই বিশাল হাসপাতাল ও কলেজ দেখে বিস্ময় নিয়েই ফিরে এলাম।

মাঝেমধ্যে সহঃ রাজস্ব কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে তাদের রেঞ্জ এলাকায় ভিজিটে যাই। একদিন গেলাম বেলকুচি উপজেলায়। সেখানে অনেকগুলো তাঁতের কারখানা আছে। বিদ্যুৎ চালিত অটোমেটিক উইভিং ফ্যাক্টরী আছে কিনা সেটা দেখতেই আমার সেখানে যাওয়া। তাহলে ভ্যাট দিতে হবে। বিদ্যুৎচালিত পাওয়া গেল না, তবে তাঁতশিল্পীদের বিভিন্ন ধরণের শাড়ি-লুঙ্গির উৎপাদন কুশলতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। আবু সাইদ বলল, বেলকুচির দই-মিষ্টি-ঘি উত্তরবঙ্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য আমাকে এখানকার দোকানগুলোর মিষ্টি খেয়ে খেয়ে দেখতে হবে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। কিন্তু কীভাবে যেন তাদের কাছে আমার আগমণের খবর চলে যায়। তাদের আগ্রহে শেষপর্যন্ত একটা বড় দোকানে বসলাম। মিষ্টি দোকানের মালিকরা অনেকেই ছিলেন। তাদের সঙ্গে বসে দই-মিষ্টি খেলাম,সত্যি এর স্বাদের তুলনা চলে না। যদি এই দোকানগুলো হাইওয়ে বা বড় রাস্তার পাশে থাকত, তাহলে এই মিষ্টিও বিখ্যাতদের তালিকায় পড়ে যেত।

এই এলাকায় প্রচুর গরুর খামার গড়ে উঠেছে। কোরবানি ঈদের জন্য গরুগুলোকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। আর আছে দুধেল গাভী। প্রতিদিন শত শত লিটার দুধ বাঘাবড়ি মিল্কভিটা প্রজেক্টে চলে যায়। সেখানে এই দুধ প্যাকেটজাত হয় এবং দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন হয়।
একদিন মিল্কভিটার কর্মকর্তারা এলেন। তাদের কাছে আমাদের অনেক বকেয়া রাজস্ব পাওনা আছে। বকেয়া রাজস্ব প্রদানের জন্য তাদেরকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। সে বিষয়ে ব্যখ্যা দিতেই তাদের আগমন।
বললাম, আমি মিল্কভিটা ভিজিট করতে চাই।

তারা পরদিন মাইক্রোবাস নিয়ে হাজির। তাদের বললাম, বিকেলে আমি শাহজাদপুর রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি ও বাঘাবাড়ি নদীবন্দর ঘুরে দেখব।
বড়াল নদীর তীরে মিল্কভিটার বিশাল প্রজেক্ট। ইন্সপেক্টর মনসুর, সিপাই আবু সাইদ ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক জিন্নাহ আমার সঙ্গী হয়। দুপুরে থাকে তাদের চমৎকার খাবারের আয়োজন। জিন্নাহকে গেস্টরুমে বিশ্রামে রেখে আমি কারখানার উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বকেয়া আদায় নিয়ে কথা বলি। মিল্কভিটা প্রজেক্টের ভিতরে সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান আছে, আর তাদের সংগ্রহে আছে ফ্রিজিয়ান গোত্রের বিশাল দুটি ষাঁড়, যাদের কাছ থেকে সীম্যান সংগ্রহ করা হয়। এই প্রকল্পটি সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি সমবায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। তবে তার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চল নদীবিধৌত হওয়ায় এই এলাকার মানুষ কৃষির পাশাপাশি দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভীপালনেও সফলতা অর্জন করে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন শাহজাদপুরের জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন চাষীরা গোচারণভূমির অভাবের কথা তাঁকে জানান। রবীন্দ্রনাথ তখন বুড়িপোতাজিয়া ও রামকান্তপুর এলাকায় ১২০০ একর জমি লাখেরাজ দান করে দেন। বর্তমানে যে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে তা ওই সম্পত্তির ২০০ একর জায়গার উপর স্থাপন করা হয়েছে। তিনিই প্রথম এই এলাকায় গাভী প্রজননের জন্য উন্নতজাতের ষাঁড় আনয়ন করেন। যাইহোক এই অঞ্চলে এত বেশী দুগ্ধের উৎপাদন হতো যে ভোক্তার অভাবে তারা দুধের ন্যায্য মূল্য পেত না। এমতাবস্থায় দেশবিভাগের আগে থেকেই একটা সমবায়ী প্রকল্প সৃষ্টি করে কলকাতাকে টার্গেট করে দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও পরিবহনের প্রচেষ্টা হয়। সে চেষ্টা পরবর্তীতে দেশভাগের পরও অব্যাহত থাকে। কিন্তু একসময় সেটা মুখ থুবড়ে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইউএনডিপি ও ডেনমার্কের ডানিডা প্রকল্পের সহযোগিতায় এদেশের দুগ্ধশিল্পের উন্নয়ন বিষয়ে স্টাডি করা হয়। তারা ভারতের ‘আমুল’ প্রকল্পের পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে দুগ্ধশিল্প বিকাশের সুপারিশ করে। ১৯৭৩ সালে সরকার ‘সমবায় দুগ্ধ প্রকল্প’ নামে ১৩ কোটি ১২ লাখ টাকার এক প্রকল্প গ্রহণ করে। ১৯৭৫ সালে ১লা ফেব্রুয়ারি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী বাঘাবাড়ি নামক স্থানে মিল্কভিটার সর্ববৃহৎ প্লান্ট উদ্বোধন করেন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড ( মিল্কভিটা) নামে এর নামকরণ করা হয়। প্যাকেটজাত তরল দুধ ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানে ঘি, মাখন, আইসক্রিম,দই, চকলেট উৎপাদন করা হয়।

উত্তরবঙ্গের অনেকগুলো জেলায় জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয় বাঘাবাড়ি ডিপো থেকে। চট্টগ্রাম থেকে এই জ্বালানি তেল এই অঞ্চলে আনয়নের সবচেয়ে সাশ্রয়ী রুট হচ্ছে নদীপথ বেয়ে এই বাঘাবাড়ি নদীবন্দরে আগমন। কেবল পেট্রোলিয়াম জ্বালানি নয় সার ও অন্যান্য ভোগ্যপণের যোগানও আসে এই নদীবন্দর পথে। অপরাহ্নের আলোয় নদীবন্দরে কর্মরত শত শত শ্রমিকের মাথায় করে সারের বস্তা বয়ে আনার দৃশ্য দেখলাম। লাইন বেঁধে মালামাল কাঁধে বা পিঠে বয়ে এনে খোলা জায়গায় ডাম্পিং করছে। এখানে প্রয়োজন ছিল একটা দুটা শেড, তাহলে স্তূপীকৃত পণ্য নিরাপদ থাকত।
বড়াল নদীর উপর দীর্ঘ ব্রিজ যা ওপারের পাবনা জেলাকে সংযুক্ত করেছ। নদী পেরিয়ে সামনে গেলে রাস্তা তিন ভাগ হয়ে যায়। একটা চলে যায় সরাসরি পাবনার দিকে,একটা গেছে নগরবাড়ির দিকে আরেকটা গেছে ইশ্বরদীর দিকে।
আমাদের এবারের গন্তব্য রবীন্দ্রনাথের কাচারিবাড়ি। এটা শাহজাদপুর বাজারের খুব কাছেই।

আমরা যখন কাচারিবাড়িতে পৌঁছলাম, তখন বিকেল পড়ে এসেছে। এটা দোতলা হলুদ রঙের বাড়ি। উপরে নিচে চওড়া বারান্দা। বাড়ির সামনে খুব যত্নে গড়া ফুলের বাগান। আমরা তখনো বাইরে থেকে ছবি তুলছি ক্যামেরায়। বাড়িটাকে ঘিরে অনেক জায়গা, ফুলের বাগানের অংশ বাদ দিলে বাকিটা নানারকম শীতকালীন সবজির চাষবাস হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪২ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে শাহজাদপুরের জমিদারী মাত্র ১৩ টাকা ৮ আনায় ক্রয় করেন। একই সময়ে তিনি শিলাইদহ ও পতিসরের জমিদারীও নিলামে ক্রয় করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুর ও অন্যান্য জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৮৯০ সালে। তিনি একইসময়ে শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসরেও জমিদারীর কাজে অবস্থান করতেন। শাহজাদপুরে তাঁর অবস্থানের মেয়াদ ছিল ১৮৯৬ পর্যন্ত। সোনারতরী কাব্যগ্রন্থের কিছু কিছু কবিতা তিনি শিলাইদহের পাশাপাশি এখানেও রচনা করেন। এছাড়া এখানেই তিনি চিত্রা, চৈতালি, গীতাঞ্জলি ও বিসর্জনের মতো কালজয়ী সাহিত্য রচনা করেন।

শাহজাদপুরের এই কাচারি বাড়িটি ১০ বিঘা জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। পাকিস্তান আমলে এই বাড়িটি তহশিল অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশ হওয়ার পর এটাকে ‘রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর’ ঘোষণা করা হয়। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত চেয়ার টেবিল,বেহারার পালকি, পালঙ্ক,রবীন্দ্রনাথের আঁকা শিল্পকর্ম ও কিছু আলোকচিত্র সংরক্ষিত আছে।

এ-কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে জমিদারি দেখার জন্য রবীন্দ্রনাথ যদি পূর্ব বাংলায় না আসতেন, যদি পদ্মা-গড়াই নদীবেষ্টিত শিলাইদহে না আসতেন, যদি না বড়াল-করতোয়া আর চলনবিলের নদীনিসর্গের পটভূমিতে নিভৃত বাংলার পল্লী শাহজাদপুর ও পতিসরে না আসতেন তাহলে হয়তো রবীন্দ্রনাথ আজকের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে উঠতেন না। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনাসমূহ সেটা হোক ছোটগল্প, হোক উপনাস,কবিতা বা গান-সব রচনার মধ্যেই পূর্ববাংলার পল্লী ও মানুষের গল্পই আমাদের চোখে পড়ে। পূর্ব বাংলার মেঘময় আকাশ, বিশাল জলরাশির চলনবিল, নিঝুম পল্লী আর বৃষ্টিস্নাত সবুজ প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতায় নতুনমাত্রা যোগ করেছিল। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘পৃথিবীর অনেক জায়গায় বসে লিখেছি,কিন্তু সাজাদপুরের মতো লেখার প্রেরণা আমি আর কোথাও পাইনি।’

পোস্ট মাস্টার, অতিথি, ছুটি, সমাপ্তির মতো কালজয়ী গল্প তিনি শাহজাদপুরে বসেই রচনা করেছেন, এইসব গল্পে বর্ণিত নদী-নিসর্গ কিংবা প্রকৃতির যে সৌন্দর্য, ঔদার্য অথবা প্রকৃতির নিষ্ঠুর আচরণের যে বর্ণনা দেখতে পাই, তা-তো এই জনপদেরই জীবনছবি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “একানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে বড়ো একটি নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ,নিস্তব্ধতা, নির্জনতা,পাখিদের বিশেষত কাকের ডাক এবং সুদীর্ঘ সুন্দর অবসর- সবসুদ্ধ জড়িয়ে আমাকে ভারি উদাস ও আকুল করে।” (ছিন্নপত্র)

শাহজাদপুর দেখে আসার পর স্বাভাবিকভাবেই আমার পতিসরের ভাবনা এলো। সিরাজগঞ্জ থেকে পতিসরও খুব দূরে নয়। আত্রাই উপজেলার নাগর নদী তীরে পতিসর কাচারি বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ এখানে বসেই রচনা করেছিলেন উপন্যাস গোরা, ঘরেবাইরে, বিদায় অভিশাপ।

পতিসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘আমাদের ছোট নদী’ নামের অসাধারণ সুন্দর কবিতা।
“আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি
দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি “/

আজও এর প্রতিটি পঙক্তি আমাদের স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে। তারপর –
‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ,কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়,
একেবারে উড়ে যায়;
কোথা পাবে পাখা সে?
এই ‘তালগাছ’ কবিতাটিও তিনি এই পতিসরে বসে লিখেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান ১৯১৩ সালে। নোবেল পুরষ্কারের টাকায় তিনিই প্রথম সমবায় ও ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু ঋণগ্রহীতারা সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারেন নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি বরং কৃষককে ঋণ প্রদানের সহযোগিতার লক্ষ্যে তিনিই প্রথম কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এই অঞ্চলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারের লক্ষ্যে তিনি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন।

আমার ঢাকায় বদলির আদেশ হলো। ঢাকা (উত্তর) আমার নতুন কমিশনারেট। আমার সহকারী কমিশনার মাহফুজ আলম জাঁকজমকের সাথে আমার বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য বাংলা সাহিত্যের অমর লেখকদের অনেকগুলো বই (উপন্যাস) নিয়ে এলেন। বললেন, সিরাজগঞ্জে এর চেয়ে আর বেশি পাওয়া গেল না।
সিরাজগঞ্জের সব ভালো,কিন্তু লাইব্রেরিগুলোতে ভালো বই রাখে না।যা রাখে তা-ও পাইরেটেড। আমার তরুণ বসের দোষ কী!

- Advertisement -

Latest Posts

Don't Miss

Stay in touch

To be updated with all the latest news, offers and special announcements.