শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪
14.6 C
Toronto

Latest Posts

আমার ছড়ার জার্নি > যদি থাকে নসিবে…

- Advertisement -

লুৎফর রহমান রিটন

সেই সত্তর এবং আশি দশকের একটা সময় ছড়াকারদের মধ্যে, বিশেষ করে উদীয়মান তরুণদের মধ্যে ভয়াবহ একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। সেটা ছিলো ছড়া লিখতে গিয়ে মিল বিষয়ে অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়া। প্রবণতাটা খুব দ্রুতই একটা অসুখে পরিণত হয়েছিলো। সেই অসুখটা খুব সহজেই কাবু করে ফেলেছিলো প্রায় সবাইকে। খানিকটা আক্রান্ত হয়েছিলাম আমিও। অভিনব এবং তিন বর্ণ চার বর্ণ পাঁচ বর্ণের মিলের খোঁজে তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল ছড়াকারদের দিশেহারা অবস্থা। কিছুদিনের মধ্যেই আমি নিজের মধ্যে সেই ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক প্রবণতাটাকে আবিস্কার করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সরে এসেছিলাম। অভিনব মিলের দরকার নেই, আমি খুব স্বাভাবিক সাধারণ আটপৌরে বা ক্যাজুয়াল মিল দিয়েই মানোত্তীর্ণ ভালো কিছু ছড়া লিখবো বলে মনঃস্থির করে ফেললাম। অসুখটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে বাঁচলো। বেঁচে গেলাম আমিও।
তখন, মিলের কের্দানি দেখাতে গিয়ে আমার কোনো কোনো বন্ধু এমন সব ছড়া রচনা করতে থাকলো যাতে কয়েকটা মিল ছাড়া আর কিছুই থাকতো না।

সেই সময়ে, দৈনিক বাংলার কিশোরদের পাতা ‘সাত ভাই চম্পা’র সম্পাদক ছিলেন আফলাতুন ভাই। প্রতি বুধবার দৈনিক বাংলার তিন তলায় তাঁর অপরিসর কক্ষে আমরা একদল তরুণ নিজের লেখা নিয়ে বসে থাকি। তিনি একেক জনের একেকটা লেখা হাতে নেন তারপর লেখাটা খানিক উচ্চস্বরে পড়েন এবং পড়তে পড়তে সিলেক্ট করেন কিংবা বাতিল করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লাল বল পেনে কাটাকুটি করেন বিস্তর। এই সময়টায় তিনি কোন শব্দটা কেনো কাটছেন বা পরিবর্তন করছেন, লেখার কোথায় কোন ত্রুটি ঘাপটি মেরে রয়েছে, সংকটটা কোথায় এবং সেই সংকট থেকে উত্তরণের উপায়টা কি সেসব বিস্তারিত বলতেন। কয়েক ঘন্টার বিস্তর কাটাকুটি আবার কপি করা ফের কাটাকুটি এইভাবে বেশ কয়েকটা গদ্য-পদ্য নির্বাচন করে খাতায় সেগুলো এন্ট্রি করে পিওন কালামকে দিয়ে প্রেসে পাঠাতেন। প্রেসকপিগুলো খাতায় এন্ট্রি করার কাজটা করতাম আমি। আফলাতুন ছিলেন আমাদের শিক্ষকের মতো। বুধবারের এই লেখা নির্বাচন প্রক্রিয়াটা ছিলো একটা ক্লাশের মতো। কতো কিছু যে শিখেছি আমি আফলাতুন ভাইয়ের কাছে!

- Advertisement -

অহেতুক মিল দিয়ে ছড়া লেখার অসুখ থেকে আমি নিস্কৃতি পেলেও বন্ধুদের কেউ কেউ পেলো না। একদিন, সেই বুধবারের লেখা নির্বাচনের ক্লাশে সৈয়দ নাজাত হোসেন একটা ছড়া নিয়ে এলো যেটা পড়ে আফলাতুন ভাই ভীষণ রেগে গেলেন। ষোলো লাইনের ছড়ায় নাজাতের দেয়া আটটা মিলকে তিনি লাল বল পেনে গোল গোল আটটা চিহ্নের মধ্যে মার্ক করলেন। তারপর ছড়ার ভেতরের কথাগুলো গদ্যে বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু দেখা গেলো কথাগুলো এলোমেলো। মিনিংলেস। বোঝাই যাচ্ছে কয়েকটা মিলকে কায়দা করে বসাতে গিয়েই যে বিপর্যয়টা ঘটে গেছে, সেটা নিরাময়হীন। সম্পাদনা করতে ব্যর্থ হয়ে আফলাতুন ভাই নাজাতকে বললেন একেকটা প্যারা তুমি নিজেই পরো তারপর আমাদের বুঝিয়ে বলো কি লিখলা। আফলাতুন ভাইয়ের টাস্কটা করতে গিয়ে নাজাত পড়ে গেলো বেকায়দায়। তার অবস্থা কেরোসিন। ষোলো লাইনের ভেতরে যে গল্পটা সে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলো তার কোনো মাথামুন্ডু নেই। আগা মাথা নেই। হাস্যকর পরিস্থিতিতে নাজাতের অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। প্রচণ্ড রেগে গেলেন আফলাতুন ভাই। খিস্তি করলেন। তারপর বললেন–এক কাজ করি, আমি তোমার খালি মিলগুলারে ছাপি দেই কি বলো? মিয়া ফাইজলামি কইরতে আসচো? বলতে বলতে শাদা অফসেট পেপারে লিখে নিয়ে আসা ছড়াটাকে খাবলা দিয়ে ধরে দুমড়ে মুচড়ে গোল্লা বানিয়ে সেই গোল্লাটাকে ছুঁড়ে ফেললেন তিনি বিনের মধ্যে।
কী একটা অবস্থা!

বিনের মধ্যে ছড়াটাকে ফেলে দিয়ে আফলাতুন ভাই বললেন–তুমি এই ছড়াটা অন্য যে কোনো পত্রিকায় লই যাও ছাপা হই যাইবো। কিন্তু মনে রাইখো, ছাপা হইলেই সেইটা লেখা হয় না।

পরের সপ্তাহে আফলাতুন ভাই নিজেই একটা ছড়া লিখে নিয়ে এলেন। ছড়াটা দৈনিক বাংলার আর্টিস্ট সৈয়দ লুৎফুল হকের হস্তাক্ষরে কপি হয়ে তা থেকে ফিল্মপজিটিভ হিশেবে দুই কলাম ব্যাপি ছাপা হলো। ছড়ার শিরোনাম ছিলো–‘ছাপা হলেই হয় না লেখা’।
সত্তর-আশি দশকের সেই অহেতুক অন্ত্যমিলের কোশেশ নামের অসুখটা ভাইরাসের মতো বাতাসে ঘুরে বেড়ায় এখনো। বর্তমানের কোনো কোনো ছড়াকারও তার পূর্বসূরিগণের মতো প্রায়শঃ আক্রান্ত হয় সেই ভাইরাসে। আমি বেদনার সঙ্গে সেটা লক্ষ্য করি। আগ বাড়িয়ে কাউকে কাউকে বলার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু কাজ হয় না। কারণ এই অসুখটা ভয়াবহ। যার হয় সে মনে করে ছড়ার মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে গিয়েছে সে। সুতরাং কারো কোনো পরামর্শের দরকার নেই তার। যে পরামর্শটা দিচ্ছে সে হয়তো চাইছে না অন্য কেউ চমৎকার অন্ত্যমিলের ক্যারিশমা দেখাক। হাহ হাহ হাহ।
নাদানরা বোঝে না ক্যারিশমা আর কের্দানি এক জিনিস নয়।
ক্যারিশমাটা শিল্প আর কের্দানিটা জবরদস্তি।
ছড়া কোনো জবরদস্তি পছন্দ করে না।
ছড়া হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততার শৈল্পিক প্রকাশ।
ছড়ায় জবরদস্তি ঘটালে ছড়ার ক্যানভাস থেকে শিল্পটা সটকে পড়ে।

আজ বিকেলের কফি টাইমে বেশোর শপিং সেন্টারের ফুড কোর্টে ‘যদি থাকে নসিবে আপনি আপনি আসিবে’ গানটা গুণগুণ করতে করতে খামোখা মিল দেয়ার প্রবণতার বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম যখন, তখন আচমকা একটা আইডিয়া এবং যদি থাকে নসিবে আপনি আপনি আসিবের ফর্ম্যাটে ছড়ার দুটো পঙ্‌ক্তি এসে প্যারেড করা শুরু করলো। ঝটপট আমি পঙ্‌ক্তিগুলোকে ধরে ফেলার পর অতি দ্রুত যে ছড়াটা দাঁড়ালো সেটা এরকম–

[ যদি থাকে নসিবে…
লুৎফর রহমান রিটন
যদি থাকে নসিবে–
হাসতে হাসতে আপনি আপনি মিলটা এসে বসিবে।
মিলের জন্যে হন্যে হবার নেই প্রয়োজন বুঝিলে?
আসল ছড়া দেয় না ধরা খামোখা মিল খুঁজিলে।
মিল আসিবে অটোম্যাটিক ছন্দ দোলা থাকিলে
কাকের কোনো হয় না তো লাভ বিরিক্ষে বেল পাকিলে।
কাকের ভাগ্যে জোটে না বেল, বেল পেড়ে খায় মানুষে
মিলগুলো সব ভাসতে থাকে দূর আকাশের ফানুসে।
এই ফানুসটা দৃশ্যমান না সাধারণের নয়নে।
বিরতিহীন সাধনা আর সঠিক শব্দ চয়নে–
ছড়ার দেবী মুগ্ধ হলেই আশীর্বাদটা পশিবে।
আপনি আপনি অটোম্যাটিক মিলটা এসে বসিবে–
যদি থাকে নসিবে…]
এক্ষেত্রে ‘যদি থাকে নসিবে’ গানটির কয়েকটা কলি স্মরণে আনতে পারি–
‘যদি থাকে নসিবে/ আপনি আপনি আসিবে/ জোর করে মন হরণ করো না করে সলনা/ এই যে নিঠুর যন্ত্রণা’…
ছড়ার সঙ্গেও ‘জোর করে মন হরণ করো না করে সলনা’……
ছড়ার মধ্যে জবরদস্তি অপ্রাসঙ্গিক মিল দেয়াটাও এক ধরণের ‘সলনা’ বা ছলনা। মনে রাখতে হবে, ছড়া কোনো ছলনা পছন্দ করে না।
ছড়া কোনো ছলনা সহ্যও করে না।
@
অতঃপর হে ছড়াবন্ধুগণ, তোমরা খামোখা মিলের পিছনে ছুটিতে ছুটিতে ছড়া হইতে ছুটি লইও না। টোটাল ছড়ায় মনোনিবেশ করো। মিলের কের্দানি না দেখাইয়াও উত্তম ছড়া রচনা সম্ভব। মাঝে মধ্যে সামান্য মিলের কের্দানি ভালো কিন্তু সারাক্ষণ মিল লইয়া থাকিলে ছড়ার পঙ্ক্ষিটি উড়িয়া যাইবে। তখন কেবল থাকার মধ্যে হাতে থাকিবে কয়েকটি অন্ত্যমিল।
মনে রাখিও ‘মিল থাকিলেই হয় না ছড়া’…
অটোয়া ০১ জুন ২০২৩
[আশির দশকে লুৎফর রহমান রিটন। সাল ১৯৮৫।
আলোকচিত্রীঃ বাতেন সিরাজ]

 

- Advertisement -

Latest Posts

Don't Miss

Stay in touch

To be updated with all the latest news, offers and special announcements.