সম্প্রতি বাংলাদেশ আর আসামের বইমেলায় প্রকাশিত তাসমিনা খানের লেখা প্রথম বই ‘অটিসম কোন অভিশাপ নয়’ এর জাঁকজমকপূর্ণ প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় গত ৬ মে টরন্টো শহরের বাংলাদেশ সেন্টারে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত লেখক, গবেষক, অনুবাদক, এবং টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব সুব্রত কুমার দাস। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন টরন্টো শহরের অন্যতম মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, এনআরবি টেলিভিশনের সিইও এবং বাংলা মেইল পত্রিকার সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মিন্টু। লেখক আকতার হোসেন, গবেষক সুজিত কুসুম পাল, কবি চয়ন দাস এবং সমাজকর্মী ইমাম উদ্দিন বইয়ের উপর আলোকপাত করেন।
সভাপতির বক্তব্যে সুব্রত কুমার দাস বইটি সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত মতামত তুলে ধরেন। তিনি সপ্রশংস চিত্তে সমাজে বইটির মূল্যবান ভূমিকা রাখার বিষয়টি তুলে ধরেন এবং বইটির উত্তরোত্তর লোকপ্রিয়টা বিষয়ে আশাবাদ করেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি আরও তুলে ধরেন যে, এই বইটির সূচনা লগ্নে তিনি কীভাবে ইতিবাচকভাবে লেখিকাকে উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত, এবং প্রভাবিত করেছিলেন লেখিকার অর্জিত জ্ঞানকে লিপিবদ্ধ করে পুস্তকাকারে প্রকাশনার ব্যাপারে।
প্রধান অতিথি শহিদুল ইসলাম মিন্টু লেখিকার এই বইটি সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বইটির ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে পরিচিত কিছু পরিবারে কীভাবে এই বইটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে এবং বইটির সংশ্লিষ্টতা তুলে ধরেন। তিনি লেখিকাকে আরও উৎসাহিত করেন বাংলামেইল পত্রিকায় নিয়মিতভাবে অটিসম আর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর আধেয় জুগিয়ে যাবার জন্য। তিনি আশাবাদ করেন লেখিকার এধারার আরও বই রচনা এবং প্রকাশনার ক্ষেত্রে।
অনুষ্ঠানটিতে বইটি নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন শহরের অনেক গুণী ব্যক্তি। লেখক আকতার হোসেন তাঁর আলোচনায় তুলে ধরেন তাঁর এক নিকটাত্মীয়ের সাথে বইটিতে তুলে ধরা বিভিন্ন চিত্রের সম্পৃক্ততার কথা। তিনি চমৎকারভাবে দর্শকসারির থেকে একজন বালিকার সাথে অভিনয় করে দেখান কিভাবে নিজেকে প্রথমে এগিয়ে এসে, পৃথিবীটাকে বদলাবার জন্য, সমাজে ইতিবাচকতার শেকড় স্থাপন করতে হবে। সমাজে অটিসম সম্পর্কে সচেতনতা আর একে অভিশপ্ততার করাল থাবা থেকে মুক্ত করতে হবে।
লেখক, অনুবাদক, গবেষক সুজিত কুসুম পাল তাঁর মূল্যবান বক্তব্যে তুলে ধরেন ‘অটিসম কোন অভিশাপ নয়’ বইটির বেশ কিছু কেইস স্টাডিস। বইটির থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সুজিত বলেন, সমাজ এখনো অটিসম কিংবা ডেভেলপমেন্টাল ডিলেকে ইতিবাচকভাবে নেয় না। তিনি বইটির একটি অধ্যায় থেকে উদাহরণ দিয়ে দর্শকদের শোনান কীভাবে ভিয়েতনামিস এক যুগলের জীবন ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়, কীভাবে নুয়েন তার দৃষ্টি শক্তি বিসর্জন দেয় ল্যানের পরিবার তার ডেভেল্পমেন্টাল ডিলে জনিত কারণে তাকে ল্যানের প্রেমিক হিসেবে মেনে না নেয়ায়।
কবি চয়ন দাসের বক্তব্যে উঠে আসে বর্তমান সমাজে ক্রমশ বেড়ে যাওয়া অটিস্টিক মানুষের সংখ্যা এবং এ সম্পর্কে সমাজ সচেতনতার প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ। তিনি প্রশংসা করে বলেন যে, বাংলামেইল পত্রিকায় নিয়মিতভাবে তিনি প্রতি সংখ্যায় লেখিকা তাসমিনার লেখা পড়েন এবং সে লেখাগুলো সমাজ উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।
টরন্টোর বাঙালি সমাজে দীর্ঘদিন যাবত সমাজ সেবা করে যাচ্ছেন, ইমাম উদ্দিন। তিনি একজন এমপ্লয়মেন্ট কাউন্সেলর, ক্যারিয়ার স্পেশালিষ্ট। তিনি বইটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আলোকপাত করেন বইটিতে স্থান পাওয়া একটি গল্পের প্রতি। যেখানে একটি আফগানি পরিবারে একটি অটিস্টিক সন্তান জন্মদানের পর স্বামী বেলায়েত, স্ত্রী আমিরাকে ফেলে চলে যায়। তিনটি সন্তান হয় বাবা হারা। তিনি বইটির প্রতি তীব্র আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বইটি সমাজের অনেক কাজে আসবে নিঃসন্দেহে।
ফ্লোরা নাসরিন ইভার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই দেখানো হয় একটি প্রামাণ্যচিত্র। লেখিকার সুইডেন প্রবাসী বোন ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ডিজাইনার তাজকিয়া শর্মী আর তাঁর স্বামী ভিজুয়াল এফেক্ট আর্টিস্ট প্রান্তিকের বানানো প্রামাণ্য চিত্রটি মুগ্ধ হয়ে দেখেন উপস্থিত সুধী, যাতে লেখিকার বায়োগ্রাফি তুলে ধরা হয়, সংযোজিত থাকে পরিবার ও প্রিয়জনদের শুভেচ্ছাবার্তা। এরপর লেখিকা তাসমিনা বইটি লেখার পেছনের গল্প বলে শুরু করেন বইটি সম্পর্কে তাঁর প্রেজেন্টেশন। উল্লেখ করা যেতে পারে, তাসমিনা খান এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করেছেন। তিনি বিহেভিয়ার এনালাইসিসে উচ্চতর ডিগ্রি আহরণ করা ছাড়াও, একই ফিল্ডে গত আট বছর ধরেই কাজ করে যাচ্ছেন।
এরপর প্রশ্নোত্তর পর্বে উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে অংশ নেন সামিনা চৌধুরী নাসরিন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সামিনা ইতিমধ্যে বইটি পড়ে জনপ্রিয় পত্রিকা বাংলামেইলে বইটির একটি চমৎকার রিভিউ লিখেছেন। কবি ও ডেভেলপমেন্টাল সেক্টর ওয়ার্কার হোসনে আরা জেমি তাঁর দেখা অটিসম এবং তেমনি কিছু মানুষের সাথে কাজ করবার অভিজ্ঞতার সাথে বইটির সম্পৃক্ততা তুলে ধরেন। ইটোবিকক থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা বইটির পাঠক সাবিনা শারমিন বইটি পড়ে তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।
মোড়ক উন্মোচনের পর অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সঙ্গীতানিষ্ঠান। সঙ্গীত পরিবেশন করেন প্রতিষ্ঠিত গায়ক অরুণাভ ভট্টাচার্যী, শিল্পী সুমি বর্মণ এবং শিল্পী সঙ্গীতা মুখার্জি। উপস্থিত দর্শকদের অনুরোধে লেখিকা তাসমিনা খান নিজেও দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান।