আগামী ১২ মার্চ থেকে টরন্টোতে আহমেদ হোসেনের নির্দেশনায় ইতোমধ্যে বহুল প্রশংসিত মনোলগ ড্রামা’ তিন কন্যার উপাখ্যান’ আবার মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে । নাটকটির বারতম মঞ্চায়ণ হয়েছিল গতবছর ৩১ অক্টোবর, যেখানে একজন দর্শকের ভূমিকায় থাকতে পেরে নিজেকে কেন খুব সৌভাগ্যবান মনে করেছিলাম সে প্রসঙ্গে পরে আসি তবে বিস্মিত হয়েছিলাম টরন্টোর সাংস্কৃতিক অঙ্গণের প্রিয় মুখ আহমেদ হোসেন কি করে এই দুর প্রবাসে এমন একটি সফল প্রযোজনা ও নির্দেশণার কাজটি করেছেন সেটা দেখে ! সেই নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগুন ঝরা ফাগুন ভরা সাংস্কৃতিক চর্চার সোনালী অধ্যায়ের দিনগুলোকে পিছনে ফেলে যিনি তের হাজার মাইল দূরে এই কানাডাতে অভিবাসী হয়েছিলেন কিন্তু নাট্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার উদগ্র
নেশাকে তিনি অবদমিত করতে পারেননি মোটেও। রক্তে যার নাটকের নেশা সেই নেশার কাছে বিসর্জিত হয়েছে বিষয় ভাবনা , কথিত ধন সম্পদ প্রতিপত্তির লোভ। সব কিছুর উপরে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন সব্যসাচী অনন্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসবে। দশ বছর ধরে তিনি এই পরবাসী বাঙালিদের যাপিত জীবনে এনে দিয়েছেন আপন সংস্কৃতির স্নিগ্ধতার পরশ। গত এক যুগ ধরে একের পর এক নাট্য মঞ্চায়ণ, আবৃত্তি চর্চা, চলচ্চিত্র ভাবনা, চলচ্চিত্র আন্দোলন, অনুষ্ঠান উৎসবের আয়োজনে আহমেদ হোসেনের তুলনা যেন তিনি নিজেই।
তিন কন্যার উপাখ্যান প্রকৃত অর্থে একটি উক্তি নাটক বা মনোলগ ( Monologue) যদিও আহমেদ হোসেন এই নাটকের ধরন নিয়ে তার একান্ত নিজস্ব ধারনা থেকে আমাকে বলেছেন হ্যাঁ, ধরে নেন তিনটি নারীর জীবনের গল্প বলা, স্বগোতোক্তি বা একাকীত্বের উক্তি, বা কোন শ্রতি নাটক। আমার মনে হয়েছে আসলে তিন কন্যার উপাখ্যান তিনটি সেগমেন্টে বিভক্ত তিনটি প্রবাসী নারীর
জীবনের আখ্যান যাকে বিশুদ্ধ মনোলগ ছাড়া অন্যভাবে আলাদা করা যায় না। আধুনিক নাটক চলচ্চিত্র ও কবিতায় মনোলগের যুতসই ব্যবহারে তা শিল্প উৎকর্ষ, ধ্রুপদী নান্দনিকতার উজ্জ্বলতা পেয়েছে। প্রাচীন গ্রীক থিয়েটার থেকে মনোলগীয় ধারণাটি তুলে এনে আধুনিক বাংলা নাটকে তার সফল প্রয়োগে আমাদের নাটকে আধুনিকতার ছোঁয়া এসেছে যেখানে একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর যেমন নিজের শিল্প স্বত্তাকে উজার করে,তুলে ধরতে পারেন তেমনি আত্মকথনের একঘেয়েমি সংলাপ রচনার মুন্সীয়ানায় হতে পারে অনন্য অসাধারণ। এখানে আহমেদ হোসেনের সঙ্গে বিদ্যুত সরকার ও শামীম আহসান নাট্যকার হিসেবে শতভাগ সফল বলেই মনে করি। বিশ মিনিট ধরে দীর্ঘ নিরবিচ্ছিন্ন উচ্চারণে এক একটি ভাষণে কখনো গল্প বলা, কখনো কবিতা , কখনো নিজস্ব দর্শনের মিশ্রণে হয়ে উঠেছে অমৃত বচণ। দর্শক পিন পতন নিরবতার মধ্য দিয়ে এক একটি কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যে যেন খুঁজে পেয়েছেন আশে পাশেই দেখা তিনজন নারীকে। যাদের কেউ পুরুষতান্ত্রিক নিষ্ঠুরতা নির্মম শিকার, কেউ স্বামী
পরিত্যক্ত, কেউ দুরারোগ্য কান্সার নিয়ে তার একাকী জীবনের গান গেয়ে যাচ্ছেন, স্বপ্নহীন জীবনে তাদের স্বপ্নের কথা বলে যাচ্ছেন। আমাদের আশেপাশের অসংখ্য নারীর দুঃখ কষ্ট ও ভালবাসার উপাখ্যান যেন এই তিন কন্যার উপাখ্যান। এই পৃথিবীর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের কাছে নিজেদের ছোট বড় কষ্ট গুলোকে ঝেড়ে ফেলে আত্মসমর্পণ হল তিন কন্যার উপাখ্যান। পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত মনোলগ অভিনেতা রবিন উইলিয়াম, ভোলা ডেভিড কিংবা আল পাচিনোর ড্রামাটিক মনোলগ যেমন দর্শকদের এক নিদারুণ মুগ্ধতার সম্মোহিত করে তেমনি আহমেদ হোসেনের তিন কন্যাদের মনোলগ দর্শকদের অভিভূত করতে পেরেছে বলেই আমি মনে করি। তিন কন্যার চরিত্রে ফারিহা রহমান, ফ্লোরা সূচি ডি রোজারিও ও মুনিমা শারমিন অত্যন্ত সফল ও দাপটের সঙ্গেই অভিনয় করেছেন। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে আত্মস্থ করে খুব সাবলীল ও সাচ্ছন্দ অভিনয়ে তারা দর্শকদের মন জয় করতে পেরেছেন।
প্রবাসীদের নাগরিক ব্যস্ততা নাট্য মঞ্চায়ণের প্রধানতম অন্তরায় যেখানে মহড়ার জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করার সুযোগ অনেকের থাকে না। এ প্রসঙ্গে তিন কন্যার উপাখ্যানের নির্দেশক লেখক আহমেদ হোসেন অনুষ্ঠান শেষে একটু আক্ষেপ করেই বললেন ‘আশা ছিল বড় ক্যানভাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজা’ বা ‘রক্ত করবী, সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ উইলিয়াম সেক্সপিয়ারের কিছু একটা করার। কিন্তু সাধ ও সাধ্যের মধ্যে অনেক ফারাক । পরিশেষে তাকে আশ্বস্ত করে বললাম আপনার এই সাধটুকু পূর্ণতা পাবে একদিন, সেই মানসিক শক্তি আপনার আছে । তিন কন্যার উপাখ্যানের মঞ্চ পরিকল্পনায় ছিলেন দিলারা আফরোজ বাবু ও মৈত্রেয়ী দেবী। আলোক নির্দেশনায় হাবিবুল্লাহ টরি, রাজিব। যন্ত্র সংগীতে রাজীব । মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় ছিলেন রনি মজুমদার। নির্দেশনা : আহমেদ হোসেন।