
গত ১৮ নভেম্বর বৃহস্পতিবার কানাডায় এক অসাধ্য সাধন হলো। আর্ট গ্যালারী অব মিসিসাগা ও কিউরেটর আলি আদিল খানের কঠিন পরিশ্রম ও অক্লান্ত প্রচেষ্টায় উদ্বোধন হলো বাংলাদেশের বাইরে এই প্রথম বাংলাদেশি শিল্পীদের আঁকা ছবির বিশাল প্রদর্শনী ‘আর্ট অব এ ইয়ং নেশান: বাংলাদেশ’। একইসঙ্গে উদ্বোধন হলো বাংলাদেশ থেকে সরসরি আসা প্রদর্শনী ‘লাইটিনিং দ্য ফায়ার অব ফ্রিডম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। তাঁর ঐতিহাসিক জীবনী ও ঘটনাকে ভিত্তি করে দুর্লভ ফটোগ্রাফ, নিউজ পেপার কাটিং ও ডিজিটাল মিডিয়ায় সাজানো এই প্রদর্শনী। মুজিববর্ষ ২০২০ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে এই আয়োজনটি করেছিলো সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশান। উদ্বোধন করেছিলেন মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বোন শেখ রেহানা ও কন্যা পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে। দেশে প্রদর্শনীটির কিউরেট করেছিন রুখমনি চৌধুরী।
আর্ট গ্যালারী অব মিসিসাগার এই দুই প্রদর্শনীর একটির কিউরেটর আলি আদিল খান । অন্যটির দেখভালও করছেন তিনি।
‘আর্ট অব এ ইয়ং নেশান : বাংলাদেশ’ আলি আদিল সাজিয়েছেন দারুণভাবে । বাংলাদেশী মাস্টার্স শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদদিন, এস,এম সুলতানদের ছবি যেমন আছে তেমনি পর্যায়ক্রমে ৩৮জন শিল্পীর মধ্যে এসে শেষ হয়েছে বিপাশা হায়াত, বিশ্বজিৎ গোস্বামীর মত প্রাধান্য বিস্তার করা কম বয়সী শিল্পীরাও। গ্যালারী বড় হলে ‘আর্ট অব এ ইয়ং নেশান: বাংলাদেশে’ এর পঞ্চাশটি ছবির মধ্যে সব চেয়ে বড় ছবি আমাদের টরন্টোর শিল্পী সৈয়দ ইকবালের। ক্লায়মেট চেঞ্জে বাংলাদেশের ক্ষতি কেমনটা হবে তা তুলে ধরেছেন এই ছবিতে। ১৮ বাই ৫ ফুট উজ্বল রঙ আর ফর্মের বিমূর্ত ছবির শিরোনাম ‘টিয়ার্স অব নেচার’ বা ‘প্রকৃতির কান্না’। এই ছবিটির সামনে কিউরেটর উদ্বোধনী আয়োজন করলেন।
গ্যালারী এক্সকিউটিভ ডিরেক্টর আনা গুলবিনস্কী উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু করেন। প্রথমে প্রদর্শনীটি করতে পারায় নিজের তৃপ্তি এবং কিউরেটর আলি আদিলের অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রশংসা করেই কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাই কমিশনার ড.খলিল রহমানকে প্রদর্শনী সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে বলেন।
হাই কমিশনার নিজের উচ্ছাস প্রকাশ করেন। তিনি খুশিতে আপ্লুত, দেশ থেকে এত দূরে এই কানাডার মাটিতে বাংলাদেশী শিল্পীদের ছবির এমনতর বড় আয়োজনের জন্যে গ্যালারীকে এবং কিউরেটর আলি আদিল খানকে আন্তরিক ধন্য্যবাদ জানালেন । প্রশংসা করে বলেন, কানাডা নবীনদেশ বাংলাদেশের শিল্প ও শিল্পীদের জন্যে আজ যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলো তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আনা এরপর সাউথ এশিয়ান আর্ট স্পেশালিস্ট ও কিউরেটর আলি আদিলকে বলতে বলেন প্রদর্শনীর ব্যাপারে । আলি আদিল কথা শুরু করেই শিল্পী সৈয়দ ইকবালকে ডেকে পাশে দাঁড় করিয়ে পরিচয় করিয়ে দেন দর্শকদের সঙ্গে। জানালেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইকবালের অনুপ্রেরণায় তার এই শিল্প আয়োজক ও ছবি কালেক্টার হিসাবে পথ চলা শুরু এই টরন্টোতে ২০ বছর আগে। বাংলাদেশের বেঙ্গল গ্যালারী অব ফাইন আর্টসের পরিচালক সুবীর চৌধুরীকে রাজী করায়, আমার সাগা সাউথ এশিয়ান গ্যালারী অব আর্টের সঙ্গে যৌথভাবে টরন্টোর প্রেস্টিজিয়াস আর্ট ডিস্ট্রিক্ট ইয়র্কভিলে হিটাইট গ্যালারীতে ২৪জন বাংলাদেশী শিল্পীর ছবির প্রদর্শনী ‘ফ্রম ঢাকা উইথ লাভ’ ২০১০ সালে আয়োজন করতে। সেই বছরই আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত দ্বিবার্ষিক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ঢাকা যাই আমি। সঙ্গে ইকবাল থাকায় সুবিধা হয়। বয়সে বড় ছোট প্রায় সব শিল্পীদের সঙ্গে সে পরিচয় করিয়ে দেয়। শিল্পীরাও এরপর থেকে আমার সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখেন। বরং বছর যায় আর আমি সবার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি। পেন্ডামিকের আগে ইকবালেরই আইডিয়া ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর আর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতকে টরন্টোতে বাংলাদেশের আর্ট নিয়ে কিছু একটা করা যায় কিনা!
কোভিডের আগে পরপর দুই বছর আর্ট গ্যালারী অব মিসিসাগার ফান্ড রাইজিং এর জন্যে আমি সাফল্যের সঙ্গে দুইটি আর্ট অকশান আয়োজন করে দিয়েছি। বড় আকারে ফান্ড পেয়ে গ্যালারী খুশি! সেই সুবাদে তারা কোভিডের দুই বছর পার হতে একটা গুরত্বপূর্ণ ভালো বড় ছবির প্রদর্শনী আয়োজনের অনুরোধ করে আমাকে। আমার মাথায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ ছিলো। দীর্ঘ বিশ পৃষ্ঠার প্রপোজাল লিখে দিতেই আর্ট গ্যালারী অব মিসিসাগার বোর্ড মেম্বার ও ট্রাস্টিরা মেনে নিলেন। তবু প্রসিডেন্ট ও ডিরেক্টরের দ্বিধা ছিলো যেহেতু আমি ভারতে হায়দরাবাদে জন্মালেও একজন পাকিস্তানী কানাডিয়ান। স্রোতের বিপরীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে এত বড় প্রদর্শনী সামলে নিতে পারবো কিনা!
আলি আদিল খান আরও বলেন, আমি আজ প্রমাণ করতে পেরেছি রাজনৈতিক বর্ডারের চেয়ে মনুষত্ব ও আন্তরিক ভালোবাসাই বড়। আজ আপনারা একই সাথে দুইটি প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন এটাইতো বড় প্রমাণ। আমার এই সাফল্যের বড় সাপোর্ট ছিলো বাংলাদেশের বিশ্ববিখ্যাত ঢাকা আর্ট সামিটের জনক রাজীব, নাদিয়া সামদানী এবং তাদের ফাউন্ডেশান। তাদের ‘লাইটিনিং দ্য ফায়ার অব ফ্রিডম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ যুক্ত হওয়াতে প্রদর্শনীর মর্যাদা আকাশ ছুইয়েছে।
‘আর্ট অব এ ইয়ং নেশান:বাংলাদেশ’ প্রদর্শনীটিতে এই প্রথমবারের মতো প্রবাসের মাটিতে মাস্টার্স আর্টিস্ট শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, এস,এম,সুলতান, মুর্তাজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, মাহমুদুল হক, মনিরুল ইসলাম, কালীদাস কর্মকার, হামিদুজ্জামান খান, আব্দুস শাকুর, বীরেন সোম, শহীদ কবীর, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, ফরিদা জামান, সৈয়দ ইকবাল, আলমগীর হক, মোহাম্মদ ইউনুস, তাজউদ্দিন আহমেদ, কামাল কবীর, কুহু লামনডন, রোকেয়া সুলতানা, ইফতেখার আহমেদ, দিলারা বেগম জলি, ভিনিতা করীম, কনকচাঁপা চাকমা, মোহাম্মদ ইকবাল, মাহমুদুর রহমান, তায়েবা বেগম লিপি, মাকসুদা ইকবাল নিপা, বিপাশা হায়াত, আনিসুজ্জামান আনিস, নাজিয়া আন্দালিব প্রীমা, এম,ডি,টকোন, মোহাম্মদ ফকরুজ্জামান ও বিশ্বজিত গোস্বামী স্থান পেয়েছে একই গ্যালারিতে। এতসব হাই প্রোফাইল আর্টিস্টদের এক প্রদর্শনীতে একত্রিত করা কত কষ্টসাধ্য তা এখন বুঝি, তবে আমি পেরেছি এটাই আমার ও সাগা ফাউন্ডেশানের বড় আনন্দ। এতসব স্বনামধন্য শিল্পীদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন সবাই আমাকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন, তা না হলে আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা প্রদর্শনীটি সার্থকভাবে আয়োজন করা। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে সংসদ সদস্য ও স্বনামধন্য অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা উপস্থিত থাকার কথা ছিলো। ভিসা বিলম্বে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি সেদিন। তবে তিনি ও তাঁরদল এখন টরন্টোতে অবস্থান করছেন।
আগামী ২৭ নভেম্বর দুপুর ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত আর্ট গ্যালারী অব মিসিসাগায় সুবর্ণা মুস্তাফা স্বশরীরে হাজির থেকে লাইটিনিং দ্য ফায়ার অব ফ্রিডম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আর্ট অফ ইয়ং নেশান: বাংলাাদেশ প্রদর্শনী সম্পর্কে কথা বলবেন। এছাড়া শিল্পী তাজউদ্দিন আহমেদের সদ্য প্রকাশিত পেইন্টিং বুক এর মোড়ক উন্মোচনও হবে ।
আর্ট গ্য্যালারী অব মিসিসাগা কতৃপক্ষ ও কিউরেটর আলি আদিল খান বাংলাদেশী আর্ট পছন্দ দর্শকদের আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন গ্যালারীতে আসার। প্রদর্শনী দুইটির আয়োজক সহযোগী সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশান, সি আর আই, এইজ ফাউন্ডেশান ও সাগা ফাউন্ডেশান।
মিডিয়া পার্টনাার হিসেবে সার্বিক দায়িত্ব পালন করেছে টরন্টোর এনআরবি টিভি ও সাপ্তাহিক বাংলামেইল।
প্রদর্শনী চলবে আগামী ১২ জানুয়ারী ২০২২ পর্যন্ত। ঠিকানা -আর্ট গ্যলারী অব মিসিসাগা, ৩০০ সিটি সেন্টার ড্রইভ,মিসিসাগা। গ্যালারী খোলা থাকার সময় সূচি : মঙ্গলবার, বুধবার, শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা। শনি, রবিবার ১২টা থেকে বিকেল ৪টা। সোমবার গ্যালারী বন্ধ থাকবে।
প্রদর্শনী উপলক্ষে আর্ট গ্যালারী অব মিসিসাগা চার রঙা ১০০ পৃষ্ঠার চমৎকার এককটি আর্ট ক্যাটালগ প্রকাশ করেছে। যা তথ্য ও হাই কোয়ালিটি পেইন্টিং এর প্রতিরূপ প্রিন্ট ছাপা হয়েছে। মূল্য মাত্র ২০ ডলার। আরো তথ্য জানতে হলে ৯০৫ ৮৯৬ ৫০৮৮ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।