
গত ৩ জুলাই টরন্টোর নর্থ ইয়র্কের সেলেব্রেশন বাঙ্কোয়েট হলে পাঠ-উন্মোচন করা হয় পঞ্চান্ন বছর কানাডার মাটিতে জীবন কাটিয়ে দেওয়া চুরাশি বছরের উদ্যমী বাঙালি অসিত কুমার দত্ত রচিত এবং কানাডা নিবাসী বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাস সম্পাদিত “আমার কথা: টরন্টোর বাঙালিদের কথা” বইটির | টরন্টো শহরের বিপুল সংখ্যক লেখক, চিন্তাবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, সমাজকর্মী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ীসহ বিশিষ্টজনদের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে সন্ধ্যে ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন হয় এই আয়োজন। সমগ্র অনুষ্ঠানটির পরিচালনা ও উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন দেবাঞ্জনা মুখার্জি |
প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা এই বইটির রচয়িতা ৫৫ বছর আগে টরন্টো শহরে অভিবাসী হওয়ার পর থেকে হয়ে উঠেছেন আজকের সফল প্রবীণ ব্যবসায়ী অসিত কুমার দত্ত। উদ্যমী সেই ব্যবসায়ীর অভিজ্ঞতাকে পাঠকের সামনে উপস্থাপনে গত তিন বছর ধরে কাজ করেছেন বিশিষ্ট লেখক, গবেষক এবং টিভি ব্যক্তিত্ব সুব্রত কুমার দাস |
ভারতবর্ষের রাজস্থানের গোয়েঙ্কা গার্লস কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, লেখক, ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক, লেখকের চেয়ে এক বছরের জ্যেষ্ঠ ড দিলীপ চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এনআরবি টেলিভিশন-এর সিইও এবং বাংলা মেইল সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মিন্টু। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তিনি একাধারে অনুষ্ঠানটির অন্যতম প্রধান আয়োজকও ছিলেন |
শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় লেখক অসিত দত্তের উপস্থিতিতে তাঁর বক্তব্য পাঠ করেন সংস্কৃতিকর্মী বিপ্লব সোম | লিখিত সে বক্তব্যে লেখক বলেন যে, অন্য সকলের মতো তাঁর জীবনেও রয়েছে কিছু অভিজ্ঞতা। তিনি জানান, নিজের সেই সব অভিজ্ঞতাকে লিখে সবাইকে জানাতেই তাঁর এই বই লেখার প্রয়াস। তিনি উল্লেখ করেন, গত পঞ্চান্ন বছরে টরন্টো শহরে কী কী দেখেছেন সেটা সবাইকে বলতে চেয়েছেন তিনি।
বইলেখা নিয়ে লেখক অসিত দত্ত তাঁর অতৃপ্তির কথাও বলেন এভাবে, “বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালিদের নিয়েও অনেক কিছু লিখতে পারতাম। লিখতে পারতাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় টরন্টোতে আমরা সবাই মিলে যে সমাবেশ করেছিলাম সেগুলোর কথা। তখন পাকিস্তান সরকারের এক মন্ত্রী এখানে এসে পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য দিতে চেয়েছিল। এখানকার বাংলাদেশি বাঙালিদের সাথে আমরাও প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলাম।“
ড. দিলীপ চক্রবর্তী তাঁর সমাপনী বক্তৃতায় উল্লেখ করেন ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত শংকরের লেখা “জানা দেশ: অজানা কথা” বইয়ের যে বইতে শংকর মর্যাদার সাথে অসিত কুমার দত্ত এবং তাঁর বন্ধু সনাতন মোহান্তর প্রসঙ্গ টেনেছেন অনেকখানি জায়গাজুড়ে।
বইটির সম্পাদক সুব্রত তাঁর বক্তব্যে বলেন, দীর্ঘ লেখক জীবনে সেদিনের বইটি ছিল ২৮তম সংযোজন | কিন্তু গত সাতাশটি বই প্রকাশনার কোনোটিতেই তিনি প্রতি পদে এমন পীড়ার ও বাধার সম্মুখীন হননি | সব প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে উঠে সেদিন বই প্রকাশ অনুষ্ঠান সুপরিকল্পিত ও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে পারাকে তিনি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের আশীর্বাদ হিসাবেই বিবেচনা করেন| উল্লেখ করা যেতে পারে যে, লেখক তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতাগুলিকে একত্রিত করে লিখেছেন এই বই | এবং তাঁর সেই লেখাগুলি সম্পাদনা করে সুব্রত কুমার দাস বইটিকে এক অতি সুন্দর আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন| বইটির প্রকাশক বাংলাদেশের অগ্রগণ্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান “মূর্ধন্য” |
যদিও ২০০৩ সালে কর্কট রোগে আক্রান্ত লেখক অসিত কুমার দত্ত জীবন যুদ্ধ জয় করে এগিয়ে চলছিলেন, কিন্তু ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার কর্কট রোগ আবার তাঁর সাথে যুদ্ধ করতে আসে | কিন্তু উদ্যমী মনোভাব, বিপুল তেজকে বল করে কর্কট রোগকে হারিয়ে তিনি এগিয়ে চলেন তাঁর হাজার হাজার স্বপ্ন পূরণ করার লক্ষ্যে | পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সমগ্র পাঠককূলের জন্য তিনি তাঁর জীবনযুদ্ধ তাঁর অভিজ্ঞতা পুঁথিবদ্ধ করার কথা ভাবেন | আর সেই ভাবনা থেকেই এই বইয়ের জন্ম |
বিবিসির বাংলা বিভাগের সাথে যুক্ত প্রাক্তন কর্মী ও পূর্বে দীর্ঘকাল বাংলাদেশে কর্মরত সাংবাদিক সৈকত রুশদী “আমার কথা: টরন্টোর বাঙালিদের কথা” বই নিয়ে মনোজ্ঞ এক আলোচনা করেন| প্রবাসী মানুষদের লেখালেখির প্রসঙ্গ টেনে গ্রন্থটিকে অনন্য উল্লেখ করে সৈকত বলেন,”৮৪ বছর বয়সে একটি গ্রন্থ রচনা সম্পন্ন ও প্রকাশ করে লেখক হিসেবে আবির্ভূত হওয়া” একটি বিরল ঘটনা।
অনুষ্ঠানে বইয়ের “সম্পাদকের কথা ” অংশটি পাঠ করেন পেশায় চিকিৎসক সংস্কৃতিকর্মী ফাহমিদা নীপা | বইটির শেষ অধ্যায় পাঠ করে শোনান লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী তাসমিনা খান |
লেখক অসিত কুমার দত্তের পছন্দের কিছু গান দিয়ে সেদিন অনুষ্ঠানটিকে সাজানো হয়েছিল |
নর্থ ইয়র্কের টেগোর সেন্টার গড়ে ওঠার পেছনে যে মানুষটির অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল, অবদান ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে টেগোর সেন্টার গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের ব্যবস্থা করা, সেই অসিত কুমার দত্ত রবীন্দ্রসংগীত শুনতে খুব ভালোবাসেন বলেই সেই সন্ধ্যায় প্রথম পরিবেশনা ছিল বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সঙ্গীত অরুণাভ ভট্টাচার্যের কণ্ঠে “আনন্দধারা বহিছে ভুবনে ” রবীন্দ্রনাথের গানটি | অনুষ্ঠানের শেষ গানটিও ছিল রবীন্দ্রনাথের লেখা। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুভাষ দাশ পরিবেশন করেন “আকাশভরা সূর্যতারা …বিশ্ব ভরা প্রাণ … ” গানটি | এছাড়াও টরন্টোর বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী শ্যামাকান্ত সরকার পরিবেশন করেন মান্না দের কণ্ঠে পুলক বন্দোপাধ্যায় রচিত কালজয়ী গান “আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো |” গান তিনটির সাথে তবলায় সঙ্গত করেন তরুণ শিল্পী অদ্রি ভট্টাচার্য। এছাড়াও লেখক অসিত কুমার দত্তের অতি প্রিয় গান সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া “যা যারে উরে যারে পাখি” গানটি সুমাইয়া মোয়াজ্জেম গেয়ে শোনান |
জানা যায়, প্রায় দুইশত আমন্ত্রিত অতিথি নিয়ে অনুষ্ঠান সফল করতে আয়োজকদেরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বইটির সম্পাদকের বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পাঠ উন্মোচনের পরে উপস্থিত সকল অতিথিকে একটি করে বই উপহার দেওয়া হয়| অনুষ্ঠান শেষে সকল অতিথিকে নৈশভোজে আপ্যায়ন করা হয়।
(ছবি কৃতজ্ঞতায় অমল দেব)