গত ৩ জুন ছিল বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর একশো বত্রিশতম তিরোধান দিবস I সেই উপলক্ষে টরন্টো শহরের বাবা লোকনাথ আশ্রম আয়োজন করেছিল একটি মনোজ্ঞ আনন্দ উৎসবের I টরোন্টোর হিন্দু ধর্মাশ্রমে আয়োজিত এই অনুষ্ঠান দুপুরে শুরু হয়ে মধ্যরাত অবধি চলে। বাবা লোকনাথের কয়েক শো ভক্তের সমাগম হয়েছিল তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠানে I দিনব্যাপী পূজা-অর্চনা ছাড়াও ছিল সন্ধ্যায় প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক সাহিত্য পত্রিকার পাঠ-উন্মোচন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
টরন্টো শহরে লোকনাথ আশ্রমটি সতেরো বছরের পুরনো। এই আশ্রমের পক্ষ থেকে বাংলা ম্যাগাজিন অঞ্জলির তেরোতম সংখ্যাটি প্রকাশিত হলো ওইদিন সন্ধ্যার অনুষ্ঠানেই I কোভিড মাঝে দুটি বছর কেড়ে নেওয়ার পর অঞ্জলি আবার স্বমহিমায় পাঠকদের কাছে ফিরে এসেছে ওই দিনের অনুষ্ঠানে I অঞ্জলির সম্পাদকীয় পর্ষদের পক্ষ থেকে বাবা লোকনাথ আশ্রমের ডিরেক্টর সুজিত কুসুম পাল তাঁর মনোগ্রাহী বক্তব্যে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন বাবা লোকনাথের শক্তিশালী বক্তব্য ও আচরণ – একজন গেরুয়া বসনধারী হয়েও তিনি বলতে পেরেছিলেন জীবের সেবায়, জ্ঞানে ও কর্মেই মনুষ্য জীবনের আসল সার্থকতা, তাঁর আসনে নয়, সারহীন ধর্ম চর্চায় নয় | তরুণ কবি সুকান্ত ভট্ট্যাচার্য্য যে প্রত্যয় নিয়ে নিজের কবিতায় লিখেছিলেন আমিই লেনিন, সেই দৃঢ়তার প্রসঙ্গও সুজিত তুলে ধরেন তাঁর বক্তব্যে I
অঞ্জলির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচনের জন্য তিনি মঞ্চে আহ্বান জানান বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও গবেষক আকবর হোসেনকে I আকবর সম্পাদনা পরিষদের সুজিত কুসুম পাল, তাপস পন্ডিত, আশীষ রায়, অপূর্ব সাহা, চন্দন দে এবং বিজনেস এডিটর সঞ্জিত দাস এবং সর্বোপরি সমগ্র জ্ঞানী গুণী লেখক যাঁরা তাদের মূল্যবান লেখা দিয়ে অঞ্জলি ম্যাগাজিনকে সমৃদ্ধ করেছেন – তাঁদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে পত্রিকা উদ্বোধন করেন I
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাস অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁর বক্তব্য পেশ করে সবাইকে ভালো কাজের সাথে সব সময় যুক্ত থাকার মহান আদর্শে ব্রতী থাকতে বলেন | বেদের বাণীর কথা উঠে আসে তাঁর আলোচনায় I বিবেকানন্দের শিকাগো জয় করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি উপস্থিত সবাইকে যুথবদ্ধতা নিয়ে সমাজ ও নিজেকে এবং হিন্দু ধর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান I
অনুষ্ঠানে কর্কটে আক্রান্ত হয়ে সদ্য প্রয়াত লেখক ও বিজ্ঞানবাদী চিন্তক টরন্টোবাসী সাঈদ যাদীদকে স্মরণ করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় I উল্লেখ করা যেতে পারে, অঞ্জলির তেরোতম সংখ্যাতে পাঠকরা তাঁর শেষ লেখা “আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়?” পড়ার সুযোগ পাবেন |
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জন্ম ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে ১৭৩০ সালে। তিনি যোগ বলে দেহ রেখেছিলেন ১৮৯০ সালে বাংলাদেশের বারদী নারায়ণগঞ্জে I তাঁর মৃত্যুর ১৩২ বছর পর বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে টরন্টোর এই বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে একশো ষাট বছর জীবিত থাকা পুণ্য আত্মা বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে স্মরণ করার এই যে আয়োজন তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশংসনীয় I
উপস্থিত ভক্তবৃন্দ পুষ্প অর্ঘ্য ও পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণে বাবাকে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন I বাবা লোকনাথ আশ্রমের পক্ষ থেকে সভাপতি সঞ্জিত দাস এবং সাধারণ সম্পাদক অনুপ কুমার বিশ্বাস তাঁদের আন্তরিক বক্তব্যে প্রকাশ করেন কোভিডের অতিমারীর প্রকোপে গত দু বছরের পেরিয়ে আসা কঠিন সময়ের পর সবার সমাগমে এই ২০২২ সালের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পেরে তাঁদের সংস্থার সবাই কতটা আনন্দিত I
ছোটো বড়ো সব বয়সের বিভিন্ন গুণী শিল্পীদের একক সংগীত, সমবেত সংগীত, একক নৃত্য, সমবেত নৃত্য পরিবেশনায় সমগ্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত মনোগ্রাহী হয়ে উঠে ছিল I গীতি আলেখ্য, ভক্তিমূলক গান, বাংলা ও হিন্দি বিভিন্ন ভক্তিগীতির সাথে নৃত্য, রবীন্দ্রনৃত্য, শিবতাণ্ডব নৃত্য, কর্ণকুন্তী সংবাদ পাঠ – সব কিছু মিলিয়ে জমজমাট অনুষ্ঠান উপস্থিত সমস্ত দর্শকদের শেষ অবধি আনন্দ প্রদান করে I
অনুষ্ঠান পরিশেষে বিভিন্ন মানুষের হার্দিক আর্থিক সহযোগিতায় আশ্রম কর্তৃপক্ষ ভক্তদের অতুলনীয় ভোগ প্রসাদ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিল |